বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, আর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নিয়েই ভঙ্গর অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরুর পর সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক সফলতার সবচেয়ে বড় দিক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান। জাতিসংঘ মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক স্বীকৃতির ইঙ্গিত মিলেছে।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সভাকক্ষে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক বিরল। প্রথা ভেঙে এ বৈঠকে বাইডেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠকেও সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেন। কূটনৈতিক সাফল্যের আরেকটি মাইফলক দিক ভারতের নয়াদিল্লি থেকে একযোগে ১৯ দেশের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় এসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ১৯ রাষ্ট্রদূতের দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ও প্রবাসী আয়ের মূল উৎস যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে যে ইতিবাচক উত্তরণ ঘটেছে, বাইডেন ও ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফলপ্রসূ বৈঠক তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার আগ্রহের কথা জানায় চীন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপালের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠককে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে ধরা যায়।
দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভিন্নমত দমন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উত্তরণ ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খানের বৈঠকটি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ খোলার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বাংলাদেশকে ৩৫০ কোটি ঋণসহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যার ২০০ কোটি ডলার নতুন ঋণ। আইএমএফের সঙ্গেও ৩০০ কোটি ডলারের নতুন ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ১৯ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে। ড. ইউনূস রাষ্ট্রদূতদের বলেছেন তাদের ভিসা সেন্টার দিল্লির পরিবর্তে ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর করা গেলে বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই উপকৃত হবে। বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যখন ভারতের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল, এর মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় এসে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের কাছে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের উপকারে আসবে এবং এর প্রতিফলন আমাদের প্রাত্যহিক ঘটনার মধ্যে পাচ্ছি। যার মধ্যে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, পানি, এনার্জি, উন্নয়ন সহযোগিতা, কনস্যুলার সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে। এই বিষয়গুলোর ওপর আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ভারতের আকাঙ্ক্ষা হলো অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা রীতিমত নাজুক হয়ে পড়েছিল। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।