ঢাকা ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বছরের শুরুতে দানব তকমা

জনগণের আস্থা ফেরাতে বছর শেষে মরিয়া পুলিশ

জনগণের আস্থা ফেরাতে বছর শেষে মরিয়া পুলিশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয় বাংলাদেশ পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক দমন-নিপীড়নে ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। গুলিতে মারা যায় কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা। কোটা আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভের বলি হয়ে প্রাণ যায় অনেক পুলিশ সদস্যের। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভেঙে পড়ে বাহিনীটির পুরো চেইন অব কমান্ড। পুলিশ বাহিনী অলিখিতভাবে পরিণত হয় জনগণের ‘শত্রুতে’। ভুক্তভোগীদের কাছে পুলিশ মানেই ট্রমা। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের হত্যা-নির্যাতনের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি দেখে কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাজে যোগ দিলেও আস্থা ফিরে পায়নি জনগণের। নতুন বছরে সেই আস্থা ফেরানোয় জোর দেবেন বলে জানিয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

গত ২৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার প্রকাশিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে জুলাই-আগস্টে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ পরিদর্শক, ১১ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), সাতজন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই), একজন এটিএসআই, একজন নায়েক ও ২১ জন কনস্টেবল রয়েছেন। সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কাজে ফিরলেও ডাকাতি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধসহ ‘মব’ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখনো সেই ব্যর্থতার বৃত্তেই বন্দি।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে চায় ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে পুলিশের ইউনিফর্ম ও লোগো পরিবর্তনের জন্য কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জনপ্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা সফররাজ হোসেনকে। আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশি সেবা সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে নগরবাসীর অভিযোগ জমা দেয়ার জন্য শিগগির অভিযোগ বক্স খোলা হবে।

অনেক পুলিশ সদস্য এখনো পলাতক : হাসিনা সরকারের পতনের দিন গত ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেলে দেশের বহু থানা পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন সময় বঞ্চিত থাকা পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতনরা। তারা পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। সরকারের তরফ থেকেও তাদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানানো হয়। সাড়া পেয়ে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিলেও অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এখনো অনুপস্থিত। পলাতকদের মধ্যে আছেন ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সিটিটিসির সাবেক এডিসি আব্দুল মান্নান, সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল টিমের প্রধান সানাউল হক সানিসহ প্রায় অর্ধ শত উর্ধতন কর্মকর্তা। পলাতকের সংখ্যা কয়েকশ’ হবে বলে ধারণা করা হলেও বাহিনীটির দাবি এই সংখ্যা ১৮৭ জন।

পালানোর পেছনের কারণ : গত ১৫ বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে দলীয় পরিচয়ে পুলিশে নিয়োগ হয়েছে। ফলে এসআই থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত অনেক বড় পদধারীর ভূমিকা ছিল অনেকটা ‘দলীয় কর্মী’র মতো। পেশাগত কাজে তাদের ভূমিকা ছিল দলীয় কর্মীর মতো। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় পুলিশ সামনের সারিতে থেকে সরকারের নানা অন্যায় নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন তারা। বিশেষ করে সরাসরি গুলি করে হত্যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেই বেশি। তাদের গুলিতেই বেশি সংখ্যক আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। আর এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে দলীয় পুলিশ অফিসারদের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। তাদের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে শেখ হাসিনার পতনের দিনই পালিয়ে যান পুলিশের এসব বড় বড় কর্তা। তারা থানা, ফাঁড়ি ও অফিসগুলো থেকে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে জুলুম, নির্যাতন করায় তারা পালিয়ে গেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে যারা সরাসরি গুলি চালিয়েছে তাদের মধ্যে ১৩৬ জন কনস্টেবল এখনো লাপাত্তা। আর অফিসার পর্যায়ে এই তালিকায় রয়েছে ৫১ জন।

জেলবন্দি অনেকেই : সরকার পতনের পরেই অনেক পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে দেশ ছেড়ে পালানোর সময় বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই দুই মাস বিমানবন্দরে করা নজরদারি ছিল। পাশাপাশি যারা জুলাই আগস্টে গণহত্যায় জড়িত ছিল সেসব পুলিশ সদস্যরা যাতে কোনোভাবে দেশ ছাড়তে না পারে তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এর ফলে বিমানবন্দর ব্যবহার করে পালাতে গিয়ে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। তার মধ্যে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিসহ এক কন্সটেবলও আছেন। তাদের বিচার চলছে। শুধু এই দুজনই নন, গণহত্যায় জড়িত থাকায় পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশে সংস্কার চলছে : অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ পুরো বাহিনী সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।

দৃশ্যমান পরিবর্তন আসছে, পুনর্গঠনের কাজ চলমান : আইজিপি বাহারুল আলম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে এতগুলো মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন নজির নেই। এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পরও আমাদের সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোকটা দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে সেরকম সক্ষম লোকদের বাছাই করে এ কাজে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া, সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করেছি।

আরো উন্নতি দরকার, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে একটু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আরো উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা নয়। এখন যদি বলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন। জাস্ট সন্তোষজনক, কিন্তু এটা আরো ভালো হওয়া দরকার। উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলায় জড়ানো সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থ । ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলার অনেক তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। অনেকে জেনেশুনে জীবিত মানুষকে মৃত বলে মিথ্যা মামলা করেন।

আস্থা ফেরাতে জনগণের দোরগোড়ায় পুলিশ : জনআস্থা ফেরাতে বিটপুলিশিং চাঙা ও জনগণের দোরগোড়ায় দৌড়াচ্ছে পুলিশ। জনগণের অভিযোগ, সমস্যা শুনতে চেষ্টা করছে পুলিশ। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় মতবিনিময় সভার আয়োজন করছে ডিএমপি নিয়মিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত