প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয় মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সচিবালয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কেপিআই) নজিরবিহীন ভয়াবহ আগুনের উৎস খুঁজতে উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের দপ্তরে জমা দেয়ার কথা থাকলেও একদিন পিছানো হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটি।
রাজনীতিবিদ ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এই আগুনের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ৭নং ভবনে পুড়ে ছাই হয়েছে ৬টি মন্ত্রণালয়ের সরঞ্জাম, নথি-পত্র ও আসবাবপত্র। ফলে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব মন্ত্রণালয় অফিস স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী অফিসের কার্যক্রম চলছে আব্দুল গনি রোডের রেলভবনে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অফিসের কার্যক্রম চলছে জিরো পয়েন্টের জিপিও ভবনে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী অফিস চলছে ফুলবাড়ীয়ার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবনে। এছাড়া যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী অফিস চলছে জাতীয় ক্রিয়া পরিষদ, পুরানো পল্টন বায়তুল মোকাররম গেট। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অস্থায়ী অফিস চলছে বিজয়নগরের শ্রম ভবনে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অস্থায়ী অফিস চলছে ১১ নং ভবনে অর্থ উপদেষ্টার দপ্তরে।
গত বুধবার দিবাগত রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলায় থাকা ৬টি মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ রয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত বৃহস্পতিবার একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ঘটনার তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রধানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। পরে এই কমিটি বাতিল করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পৃথক কমিটি করেছে। এসব কমিটির বড় কাজ হবে ক্ষতি নিরূপণ করা।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান নাসিমুল গনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট গতকাল নয়, আজকে জমা দেওয়া হবে। এ ঘটনায় সংগ্রহ করা নমুনা বিদেশেও পাঠানো হবে পরীক্ষার জন্য। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করে তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: গৃহায়ণ সচিব, পুলিশের আইজিপি, কমিটির সদস্যসচিব থাকবেন ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে ৩ জন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।
সচিবালয়ে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরে গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, অগ্নিকাণ্ডে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের চারটি ফ্লোরের প্রায় ২০০ কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিভাবে আগুন লেগেছে সেটি তদন্ত শেষেই বলা যাবে।
তিনি আরও বলেন, ভবনটি সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে কি না, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই বোঝা যাবে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্পষ্ট হবে সংস্কার সম্ভব কি না। সংস্কার করা সম্ভব হলে সংস্কার কাজে কতদিন লাগতে পারে, সেটিও তদন্ত রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, তারা আগুন লাগার খবর পায় গত বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে। এর পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তারা। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট কাজ শুরু করে। পরে মোট ১৯টি ইউনিটের ২১১ জন কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুন পুরোপুরি নিভেছে বেলা পৌনে ১২টায়। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলের আশপাশে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অপরাধ শনাক্তকরণ দল। তাদের একটি সূত্র জানায়, ষষ্ঠ থেকে নবম তলা পর্যন্ত বেশির ভাগ করিডর, কাঠের আসবাবপত্র ও নথিপত্র পুড়ে গেছে। অল্প কয়েকটি কক্ষ অক্ষত দেখেছে। এর মধ্যে একটি কক্ষের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ও ডিভিআর অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বৃহস্পতিবার সকালে সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ফারুক ই আজম, এম সাখাওয়াত হোসেন, নূরজাহান বেগম ও শারমীন এস মুরশিদ। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এই ব্রিফিংয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই তদন্ত কমিটিকে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করে আগামী তিন দিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সচিবালয়ে ৭ নম্বর ভবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আমাদের ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না। মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার এই বক্তব্য উল্লেখ করা হয়। এর আগে এ নিয়ে ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দেন তিনি।