বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বড় পরিসরে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা সংস্কারের দিকে নজর রাখছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর জনগণের বহুল প্রত্যাশা রয়েছে। প্রত্যাশা পূরণে নতুন বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে।
রাষ্ট্রপরিচালনায় সব ধরনের সংস্কার শেষে ২০২৫ সালের শেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে নির্বাচনপ্রক্রিয়া, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তির ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। গত ১৫ বছরে ভোটার হওয়ার যোগ্য তাদের নাম ভোটার তালিকায় তোলা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে ২০২৫ সালের রমজান মাসে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম জনগণের নাগালে রাখতে হবে। গণছিনতাই, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সক্রিয় করতে হবে।
অন্তর্বর্তী শপথ নেয়ার পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে কাজটি সম্পন্ন করার কথা বলে আসছে, সেটি হলো- জুলাই-আগস্টের ‘গণহত্যার’ বিচার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে বেশিরভাগই মারা গেছেন গুলিতে। এসব হত্যার ঘটনায় এরইমধ্যে কয়েকশ’ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। শেখ হাসিনাসহ এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এসব অপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি দেশের সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বিভক্তির জায়গাগুলোয়ও নজর দিতে হবে। জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভের পর বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রদের উত্থান হয়। যদিও ছাত্ররা এখনো কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। তাদের আগ্রহের জায়গা অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরেই। এ ক্ষেত্রে তারা চায় অন্তর্বর্তী সরকার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকুক এবং বড় ধরনের সংস্কার আনুক। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি প্ল্যাটফর্ম করেছে। এ প্ল্যাটফর্মটি সংস্কারের পক্ষে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন তৈরি করতে চায়।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারে, তাহলে আগাম নির্বাচন দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার জনসমর্থন ধরে রাখতে পারলে তা দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করতে কাজে লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকার যেসব কাজ করতে চায়, তাতে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলে কেউ সরকারের পতনের অপচেষ্টা চালালেও এর জন্য রাজনৈতিকভাবে চড়া মূল্য দিতে হবে। ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রসংস্কারের বিরল যে সুযোগ এসেছে, তা হাতছাড়া হয়ে গেলে মানুষকে আবারো দুর্ভোগ পোহাতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসার মতো বিষয়গুলোর সাফল্য দেখাতে হবে।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসন আমলের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা সামনে আসছে। এরপরও বর্তমানে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। নতুন বছরে এই আকাঙ্ক্ষা কীভাবে ধরে রাখা যায়, সেটা চিহ্নিত করতে হবে ইউনূস সরকারকে। পাশাপাশি সংস্কারকাজে গতি আনতে হবে। একটি নির্বাচন আয়োজনের পথও তৈরি করতে হবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। এর মধ্যে একটি হতে পারে রাষ্ট্রীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গেঁড়ে বসা দুর্নীতি মোকাবিলা। সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরবে। পুলিশকে সড়কে ফেরাতে পারলে ঢাকার তীব্র যানজট মোকাবিলায় তা কাজে লাগবে। বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্থনীতির জন্য যেমন আশীর্বাদ হতে পারে, তেমনি এতে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে হওয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করলে তা কেবল জনপ্রিয় হবে না, একই সঙ্গে সব প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচারকদের জন্য সত্যিকারের দায়িত্ব পালনের পথ তৈরি হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। তবে মামলার নেপথ্যে রাজনীতি রয়েছে, এমন অভিযোগও উঠতে পারে। এসবের সঙ্গে দ্রুত বিচার করার যে দাবি উঠেছে, তার ভারসাম্য রক্ষার একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া পর্যাপ্ত প্রমাণাদি ছাড়া ঢালাও মামলায় যাতে কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়, সে ব্যাপারে পুলিশকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলায় সরকারের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মোটাদাগে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা, গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, জনপ্রশাসনে অস্থিরতা এবং পুলিশের নিক্রিয়তা কাটাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও দৃশ্যমান রাজনৈতিক বিতর্ক নিরসনে উদ্যাগ নেওয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ সারাদেশে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সড়কে আন্দোলনে করেছেন। গত পাঁচ মাসে অনেকের দাবি মেনে নেয়া কিংবা দাবি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। নতুন বছরেও অনেকেই তাদের দাবি নিয়ে রাজপথে নামতে পারেন। সেসব দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।