প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে আজ বুধবার বছরের শুরুর দিনই পৌঁছাচ্ছে নতুন পাঠ্যবই। তবে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পড়াশোনায় ফিরছে পুরোনো কারিকুলাম। পুরোনো কারিকুলামের আলোকে পরিমার্জিত এই নতুন পাঠ্যবই বর্তমানে ছাপার কাজ চলছে। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই প্রয়োজন ৪০ কোটির বেশি। এসব পাঠ্যে আসছে বেশ কিছু নতুন পরিবর্তন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, নতুন বছরের বইতে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ইতিহাসের অংশ থেকে অতিবন্দনা, অতিকথন বাদ দেয়া হয়েছে। আগে যাদের অবদান বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল, এমন অনেকের তথ্য যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া বয়স উপযোগী করে অনেক লেখা সহজবোধ্য করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন পরিস্থিতিতে যোগ করা হয়েছে এগুলো। বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় যুক্ত করা হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে পাঠ্যপুস্তক থেকে একেবারে মুছে ফেলা হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখা অনেক বীর ছিলেন অপাঙ্ক্তেয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদের অবদানও সেভাবে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানীর অবদানকেও খাটো করে দেখানো হয়। জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ইতিহাসে সবার সব অবদান নির্মোহভাবে পাঠ্যবইতে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে জন্যই প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়। সেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে যুক্ত হচ্ছে জিয়াউর রহমানের নাম। খালেদা জিয়ার নাম যুক্ত হবে ‘রাজনীতিতে নারী’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোয় সাতটি গদ্য ও পদ্য বাদ দেয়া হয়েছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে আটটি গদ্য ও পদ্য। প্রাথমিকের বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখাও। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি গদ্য, একটি পদ্য ও একটি জীবনী। তৃতীয় শ্রেণির একটি বই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী বাদ দিয়ে সেখানে জাতীয় চার নেতার জীবনী যোগ করা হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখা ইংরেজি গদ্যও। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে বেশ কিছু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে, যেখানে নতুন করে স্থান পাচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু।
এনসিটিবি-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত হচ্ছে পিঁপড়া ও পায়রার গল্প। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়’ অধ্যায়ের নাম পরিবর্তন করে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ করা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে নতুন যোগ হয়েছে ‘সিংহ আর ইঁদুর’-এর গল্প। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা ‘সোনার ছেলে’ বাদ দেয়া হয়েছে। যোগ করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর লেখা ‘দুখু মিয়ার জীবন’। তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে নতুন করে সংযোজন করা হচ্ছে ‘ঘাসফড়িং ও পিঁপড়ার গল্প’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা’। চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মমতাজ উদ্দীনের লেখা ‘বাংলার খোকা’ এবং নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতা ‘মুজিব মানে মুক্তি’। যোগ হচ্ছে ‘টুনুর কথা’ ও রজনীকান্ত সেনের কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’। পঞ্চম শ্রেণির বইয়েও আসছে একই রকম নানা পরিবর্তন।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্যবিষয়ক বইয়ে সাতটি গদ্য ও চারটি কবিতা বাদ দেয়া হচ্ছে। নতুন করে যুক্ত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর লেখা একটি সংকলিত গদ্যসহ মোট দুটি গদ্য। এছাড়া একটি উপন্যাস বাদ দিয়ে আরেকটি উপন্যাস যুক্ত করা হচ্ছে। একই শ্রেণির ইংরেজি বই থেকে বাদ পড়ছে একটি অধ্যায়। সে বইয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি নিয়ে লেখাসহ নতুন তিনটি অধ্যায় যুক্ত হচ্ছে। শুধু নবম-দশম শ্রেণি নয়; পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়েও বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং কবিতা সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে। যেখানে নতুন করে স্থান পেয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বাদ দেয়া হয় বাকি ছয়টি গদ্য। এগুলো হলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’, কবীর চৌধুরীর ‘পয়লা বৈশাখ’, সেলিনা হোসেনের ‘রক্তে ভেজা একুশ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘নিয়তি’ এবং ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘তথ্যপ্রযুক্তি’। জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর লেখা ‘আমাদের নতুন গৌরবগাথা’ নামে একটি সংকলিত গদ্যও যুক্ত হচ্ছে।