প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির সব বই এবং মাধ্যমিকের সপ্তম শ্রেণির তিনটি বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই পেয়েছে রাজধানীর বিদ্যালয়গুলো। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দু-একটি ক্লাসের কিছু বই দেওয়া হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বই পায়নি। কবে নাগাদ শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পাবে তারও নিশ্চয়তা দিতে পারেননি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বই না পেয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে।পাঠ্যবই ছাপার কাজটা যুদ্ধের মতো হয়েছে জানিয়ে ঠিক কবে নাগাদ সব বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া যাবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গতকাল বুধবার বছরের প্রথম দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে যেসব বই পৌঁছেছে, সেগুলোই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য বছর বই কম থাকলেও কোনও শিক্ষার্থী একটিও বই পায়নি, এমনটি হয়নি। এদিকে, বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘বই ছাপানোর কাজে পদে পদে ষড়যন্ত্র ছিল, যা অতিক্রম করা হয়েছে। আজও কোনও কোনও জেলায় ষড়যন্ত্র করে বই আটকে রাখা হয়েছিল। বই ছাপানোর কাজে অনেক প্রেসের মালিক, কাগজ উৎপাদনকারী সংস্থা কম মূল্যে কাগজ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই। এখনই সব বই ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছাতে না পেরে আমি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। সান্ত¡না এতটুকুই, বইগুলো আগের চেয়ে সুন্দর হবে এবং বছরের মাঝখানে মলাট ছিঁড়ে যাবে না।’ গতকাল বুধবার সরেজমিন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির সব বিষয়ের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি বইও দেওয়া সম্ভব হয়নি। মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-সংলগ্ন শিক্ষা অফিস পরিদর্শন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, চলতি দায়িত্ব) মো. ইমামুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির সব বই পাওয়া গেছে। অন্য শ্রেণির বই যখন পাওয়া যাবে, তখন দেওয়া হবে।’ মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুননাহার লিপি বলেন, ‘চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই পাইনি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) শুধু সপ্তম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই পাওয়া গেছে, সেগুলো দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ফতেপুর বাউসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা মো. ফারুক হোসেন জানান, চতুর্থ শ্রেণির বাংলা, গণিত ও ইংরেজি এবং পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও ইংরেজি পেয়েছেন, অন্যান্য বই পাওয়া যায়নি। এদিকে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান বলছেন ১৫ জানুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলছেন ৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেয়া যাবে। আমি কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটমেন্ট দেবো না। পাঠ্যবই কবে ছাপা শেষ হবে, তা নিয়ে আমি কিছু বলবো না। বই ছাপার প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে কিছু কথা বলবো। আমি মনে করি, পাঠ্যবই ছাপার কাজটা এবার শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মতো হয়েছে।
গতকাল বুধবার পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন ও মোড়ক উন্মোচন’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রথম সমস্যাটা হলো- আমরা বিদেশি বই ছাপাবো না। তারপর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে অনিবার্য কারণে। তাতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। যখন কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেটা অনেক দেরিতে হয়েছে। অনেকগুলো বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। রাজনীতিতে নিরপেক্ষ বলে কিছু থাকে না, দলীয় রাজনীতি নিরপেক্ষ সবকিছু যেন বইয়ে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, শিশুদের কাছে বই যাবে, সেটা ভালো কাগজে ছাপা না হলে তো হয় না। সেজন্য উন্নতমানের ছাপা, উন্নত মানের কাগজ ও মলাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এনসিটিবিতে আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের বসানো হয়েছে, তারা অভিজ্ঞ। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প সমিতির যে নেতা, তাদের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়াটা করতে হয়, এটা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই। সেটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও এর মধ্যে ঢুকতে হয়েছে।
পাঠ্যবই নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, গল্পের একেবারে শেষে গিয়ে ছাড়া যেমন ষড়যন্ত্রকারী কে তা বোঝা যায় না, এখানেও তেমন। সেটা সরকারের কেউ হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হোক, এনসিটিবির হোক, মজুতদার হোক, সিন্ডিকেট হোক। মানে যে কেউ হতে পারে। তবে এখনই আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে আমরা একচেটিয়া ব্যবসা কমিয়ে আনবো। এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।
বই দেরিতে দিলেও পাতা ছিঁড়বে না : এবার পাঠ্যবই দেরিতে দেয়া হলেও মান ভালো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বই দিতে এবার বেশ খানিকটা দেরি হচ্ছে, সেজন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এটা সত্যি দুঃখজনক।
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, তবে একটা বিষয় আমরা বলতে চাই, বই একটু দেরিতে পেলেও সেটা ভালো বই পাবেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে যাবে না। তেমন বই আমরা দিচ্ছি না। এটা নিশ্চয় ভালো দিক।
এগিয়ে যেতেই পেছনের শিক্ষাক্রমে যাওয়া : নতুন যে শিক্ষাক্রম আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয় জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, অনেকে সমালোচনা করছেন কেন পেছনের শিক্ষাক্রমে ফিরে গেলাম আমরা। আমি মনে করি, যে শিক্ষাক্রম করা হয়েছিল নতুন করে, সেটাতে থাকলে শিক্ষার্থীদের আরো পশ্চাৎপদে যাওয়া হতো।
তিনি বলেন, দুই বছর এ শিক্ষাক্রম চালিয়ে গেলে সেখান থেকে ফেরার উপায় ছিল না। সেটা সহজও হতো না। সেজন্য আমরা সাময়িকভাবে পেছনের শিক্ষাক্রমে গেছি। এটা আবার এগিয়ে নেয়ার কাজ করা হবে। এবার কিছু পরিমার্জন হয়েছে। আগামীতে আরো পরিমার্জন করা হবে। যাতে শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিকতার কোনো ঘাটতি না থাকে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক এবিএম রেজাউল করীম।
এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাবিষয়ক বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম, এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান প্রমুখ।