বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে চলছে কথার লড়াই। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন নিষ্ক্রিয় আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াত রাজনীতির মাঠে সরব হওয়ার পর দল দুটির মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ শুরু হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর দীর্ঘ ২৫ বছরের রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যে হঠাৎ কেন এমন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলো, তা নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দুই দলের মধ্যে এমন মতবিরোধ বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। তবে তাদের মধ্যে সম্পর্কের ইতি হয়নি। ফলে ভবিষ্যতেও দুই দলের মধ্যে যে সম্পর্ক উষ্ণ হবে না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। দল দুটির নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তাদের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হচ্ছে। ফলে দিনদিন বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছাচ্ছে।
সম্প্রতি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী জামায়াতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনার পর তাদের মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। বিএনপির বিরুদ্ধে সারাদেশে ‘দখলদারিত্বের’ নানা অভিযোগ আনেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি বিএনপিও জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দলের ঘটনা আগেও দেখা গেছে। তবে এবারের মতো একে অন্যের প্রতি চরম বিষোদ্গার নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা। গত রোববার জামায়াতের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করেছেন রুহুল কবির রিজভী। জামায়াত এ নিয়ে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের পেজে বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি পোস্ট দিচ্ছেন দল দুটির কর্মী-সমর্থক।
সূত্রমতে, ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গঠিত হয়। এ জোটের প্রধান দুটো দল ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে। এরপর আবার বিরোধী দলে যায়। চার দলীয় জোট থেকে ২০ দলীয় জোট হয়। শেখ হাসিনার শাসনের শেষদিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরেই নানা বিষয়ে টানাপড়েন চলছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সভা-সমাবেশের বক্তব্য-বিবৃতিতে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি চলছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই বিরোধ আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এরপরও দীর্ঘদিনের দুই মিত্র দলের সম্পর্ক ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি দুই দলের নীতিনির্ধারকরা।
রিজভীর সমালোচনা : গত রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংক লুটকারী এস আলমদের উত্তরসূরি হয়েছে অনেকে। বড় বড় কথা বলে বিএনপির নামে কলঙ্ক লেপন করছে। টেন্ডারবাজি, পাড়া-মহল্লায় টার্মিনালসহ নানা কিছু দখল করেছে একটি দল। পায়ের রগ কারা কাটে- তাদের চেনে জনগণ।
জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে রিজভী বলেন, ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন। ইসলাম মানে তো মোনাফেকি করা না। একটি দল নিজেরা মোনাফেকি করছে আর বিএনপিকে সবক দিচ্ছে; কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে, সেদিন আপনারা এরশাদ কুলাঙ্গারের নির্বাচনে যাননি? আপনাদের একাত্তরের অর্জন কী? আপনারা একাত্তরের বিরোধিতা করেছেন।
রিজভীর অভিযোগ- ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য জামায়াত শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করতে চায়। এদিতে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেটে ‘আমরা বিএনপি পরিবারের’ পক্ষ থেকে যুব এশিয়া কাপ বিজয়ী ইকবাল হোসেন ইমনের পরিবারকে শুভেচ্ছা উপহার প্রদান শেষে রিজভী একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কী ভূমিকা ছিল এ নিয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ওই রাজনৈতিক দল ছাড়া যে আর কেউ দেশপ্রেমিক নয়- তাদের এই দাবি নিয়ে মানুষ হাসবে।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জনগণ যখন অত্যাচারিত হয়েছে সেনাবাহিনী তখন জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও সেনাবাহিনী একটি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। আমি সেই রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, ইসলামপন্থি সেই রাজনৈতিক দল, আপনাদের একাত্তরে ভূমিকা কী ছিল, আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা কোনো সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন? বাংলাদেশে কেউ দেশপ্রেমিক নেই, শুধু একটা রাজনৈতিক দল দেশপ্রেমিক- এই ধারণা দিলে মানুষ হাসবে। মানুষ হাসি ছাড়া আর কিছু দেবে না।’ বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই কেবল ক্ষান্ত হননি জিয়াউর রহমান। লড়াই করেছেন। পাকিস্তানি কর্নেল জাঞ্জুয়াকে হত্যাও করেছেন। সেখানে যুদ্ধ হয়েছে। সে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন মেজর জিয়া।’
এদিকে, রুহুল কবীর রিজভীর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে জামায়াত যে ধরনের কথা বলে আসছে, তাতে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়াটা স্বাভাবিক।
বিএনপির অনেকের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদে শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র নেতাদের কারো কারো বক্তব্য ও তৎপরতার সঙ্গে জামায়াতের যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছে। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জামায়াতের এক ধরনের প্রভাব আছে বলে বলাবলি আছে।
নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার, জামায়াত ও ছাত্র নেতৃত্ব- তিন পক্ষ বিএনপি বিরোধী প্রচারণায় নেমেছে। জামায়াতের নেতৃত্বে যে জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, এটিও বিএনপিকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন তারা।
তবে জামায়াত নেতারা বলছেন, বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনগণ ক্ষুব্ধ হওয়ায় তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এতে বিএনপির ঈর্ষা হচ্ছে। বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ভেতরে ভেতরে জামায়াতবিরোধী এক ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
জামায়াতের নিন্দা : রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে বলেছেন, রিজভীর বক্তব্য বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এ ভূমিকা জাতি গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর গাত্রদাহ হয়েছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অপবাদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। রফিকুল ইসলাম বলেন, জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনও করেনি। জামায়াত ‘ইসলাম’ নিয়েও রাজনীতি করে না। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্নমতের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য বিএনপি করেছিল, তা কি জাতির সঙ্গে মোনাফেকি নয়?
ফেসবুকেও লড়াই : বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতের বিবৃতির স্ক্রিনশট এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ২০১৮ সালের একটি নির্বাচনি পোস্টার দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা- ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দর কষাকষি করে ২২ আসন বাগিয়ে নেয় জোট থেকে এবং সে নির্বাচনে ডা. শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সাথে জোট? আর কার সাথে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?’ পোস্টটি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মন্তব্যে দুই দলের কর্মী-সমর্থকরা পাল্টাপাল্টি সমালোচনা করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষ দেখা যাচ্ছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। এতে আওয়ামীপন্থিরা ‘বিএনপি-জামায়াত’ একটি রাজনৈতিক অভিধা চালু করেছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হতো বিএনপি ও জামায়াত এক ও অভিন্ন সত্তা, যা সত্য নয়।
বক্তব্য-বিবৃতিতেও বিরোধ : সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন না- এমন বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্য নিয়েও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। মূলত তখন থেকে দুই দলের মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু। এর একদিন পর এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে স্পষ্ট বলেন, ‘প্রতিশোধ না নেয়ার মানে হচ্ছে আমরা আইন হাতে তুলে নেব না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তিও হতে হবে।’
এর আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে গত ২৮ আগস্ট ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদা এক অনুষ্ঠানে কথা বলেন জামায়াতের আমির। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগী দেশ আমাদের খুবই প্রয়োজন। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন?’ জামায়াত আমিরের এসব বক্তব্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বিএনপির।
এসব বক্তব্যের পর সাতক্ষীরায় বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে দেখেছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে। সে কারণে তারা বিভ্রান্ত ছড়ায় এ রকম কিছু কথাবার্তা বলছে।’ এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকারও আহ্বান জানান তিনি।
এ ছাড়া বিএনপির নাম উল্লেখ না করে জামায়াত নেতারা প্রায়ই বলছেন, এক চাঁদাবাজ বিদায় নিয়েছে আর কোনো চাঁদাবাজ দেখতে চাই না। এক স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে, আরেক স্বৈরাচার জনগণ দেখতে চায় না। এত দিন এসব বক্তব্যের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি বিএনপি নেতারা। গত রোববার রুহুল কবীর রিজভী কঠোর ভাষায় জামায়াতের সমালোচনা করেন। দলের নেতাদের ধারণা, রিজভী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার প্রতি দলের শীর্ষ নেতার সায় আছে।
এদিকে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ছবক শুনতে জাতি রাজি নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭৫-এর ৭ নভেম্বরের পরাজিত শক্তি মিলে যারা জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, তাদের রুখে দেয়ার ক্ষমতা এদেশের জনগণ রাখে। তাদের ছবক শুনতে জাতি রাজি নয়। গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা বিএনপির উদ্যোগে কর্মীসভা ও সদস্য ফরম বিতরণ অনুষ্ঠানে গয়েশ্বর এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা অনেককেই ক্ষমা করতে পারি, ভুলে যেতে পারি। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। কিন্তু ক্ষমা করার পর একই কাজ যদি আবার করেন, তাহলে ভুলে গেলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ নভেম্বরের পরাজিত শক্তি মিলে যারা জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, তাদের রুখে দেয়ার ক্ষমতা এদেশের জনগণ রাখে। সেই নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্য নেতৃত্বও আছে। জিয়াউর রহমান হারিয়ে গেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই জায়গা থেকে শুরু করেছেন। সেখান থেকেও নেতৃত্ব হিসেবে এসেছে তাদের যোগ্য উত্তরসূরী তারেক রহমান। যুক্তরাজ্য থেকে দল ও দেশবাসীকে সংগঠিত করে বিজয় নিশ্চিত করেছেন।
নির্বাচন নিয়ে দুই মেরুতে দুই দল : সংসদ নির্বাচন কবে হবে, বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপি যতটা সরব, জামায়াত ততটাই নীরব। নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে তেমন তাড়া নেই। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় অসন্তুষ্টি জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে জামায়াত রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে সরকারকে কোনো চাপ দেয়নি। এ বিষয়ে তারা কৌশলী ভূমিকা দেখাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পর ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলে নির্বাচনের দাবি নিয়ে মির্জা ফখরুল বক্তব্য দেয়ায় প্রতিক্রিয়া জানান জামায়াত আমির। ওই সময় তিনি বলেন, বন্যায় দেশ আক্রান্ত। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না। এর জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’ তখন থেকে নির্বাচন নিয়ে দুই দলের নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। তবে তারা কেউ দলের নাম উল্লেখ করে কিছু বলেননি।
টানাপড়েন চলছেই : ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চার দলীয় জোট গঠিত হয়।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চার দলীয় জোটের কলেবর বেড়ে হয় ২০ দলীয় জোট। আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। ২০২২ সালের আগস্টে জামায়াতের মজলিসে শূরার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ২০ দলীয় জোট আর কার্যকর নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ২০২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘পরকীয়া’ করছে জামায়াত।
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, তাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট; সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দল দুটির মধ্যে প্রথম বিরোধ দেখা দেয় বর্তমান সরকারের মেয়াদ নিয়ে। এর পর সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন নিয়েও মতপার্থক্য দেখা যায় বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারকদের কথায়। এর আগে জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে বিএনপি। জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার ও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে দলটি। তখনো দুই দলের মধ্যে এক ধরনের বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। যদিও পরে দলের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে মতবিরোধের অবসান ঘটে। তবে, এবারের যে বাকযুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব চলছে তার ভবিষ্যৎ কি তা এখনই কেউ বলতে পারছে না।