সহিংসতা থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ফেরার স্বপ্ন এখনো অনিশ্চিত। স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের জন্মভূমি রাখাইনের (পূর্বে আরাকান নামে পরিচিত ছিল) নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরও ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের উদ্বেগ কাটেনি। রেডিও ফ্রি এশিয়াকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সদস্যরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চালানো রক্তক্ষয়ী অভিযানের ফলে প্রায় ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। তারা কক্সবাজারের আশপাশে আগে থেকেই বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিলিত হয়। ফলে ওই সময়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর জন্য বছরের পর বছর ধরে আলোচনা হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গারা মনে করে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর স্থানীয় বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপ দখল করে এবং বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্তেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ ঘটনা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। তারা ভেবেছিল, তারা হয়তো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিরাপদে নিজেদের পুরোনো এলাকায় ফিরে যেতে পারবে এবং এএয়ের শাসনামলে পুনর্বাসিত হতে পারবে।
তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) জানিয়েছেন, তাদের ফেরার সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত। কারণ, এএ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য কী ব্যবস্থা নেবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া, রাখাইনের চলমান সংঘর্ষ এবং সামরিক জান্তার বিমান হামলার ঝুঁকির কারণে তারা আরো আতঙ্কিত।
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী মোহাম্মদ বলেন, এখন যুদ্ধ চলছে। এই পরিস্থিতিতে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। এমনকি যদি এএ পুরো রাখাইন দখল করে নেয়, তবুও আমাদের ফেরার পথ বহু দূর। কারণ, তারা কোনো বৈধ সরকার নয়। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে, গত এক বছরে রাখাইনের সংঘাত ও সহিংসতার কারণে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে জান্তার সম্ভাব্য বিমান হামলার আশঙ্কা। ইউরোপভিত্তিক রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী নায় সান লুইন বলেন, ‘পুনর্বাসন পুরোপুরি এএয়ের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, তারা বর্তমানে সেই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে যেখানে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় আছে। তবে জান্তা যদি বিমান হামলা চালায়, তাহলে রোহিঙ্গারা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে পুনর্বাসন কার্যক্রম অসম্ভব।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি এবং মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফেরার দাবি জানিয়ে আসছে। গত ২৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারে এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘের কাছে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন চায়।
মোহাম্মদ বলেন, আমরা চাই নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে। এছাড়া, আমরা মিয়ানমার এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষার অধিকার এবং মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছি। এসব দাবির ক্ষেত্রে কোনো আপস হবে না।
সীমান্তে এএয়ের নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে, যা রোহিঙ্গাদের অনিশ্চয়তার মধ্যেই রেখেছে। গত ২২ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফি আলম সাংবাদিকদের জানান, সীমান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে ‘সমাধানের পথ খুঁজতে’ অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার এবং জানিয়েছে, তারা আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে কোনো ধরনের ‘সম্পৃক্ততায়’ যাবে না।
তবে এক সপ্তাহ পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, সাবেক কূটনীতিক এবং গবেষকেরা বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি এবং কূটনৈতিকভাবে এএয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। সম্পর্কের বর্তমান অবস্থান এখনো অনিশ্চিত।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশের সাবেক এক জেলা আইন কর্মকর্তা রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনেকাংশে রাখাইন রাজ্যের শাসনব্যবস্থার ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বর্তমানে কোনো আইনগত কাঠামো নেই। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অপরিহার্য।
প্রায় ৩০টি আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সংগঠন গত ২৩ ডিসেম্বর আরাকান আর্মিকে (এএ) রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, একটি অন্তর্বর্তী পরামর্শক কমিটি গঠন করতে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের একটি জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং এএয়ের যোদ্ধাদের জন্য একটি প্রকাশ্য আচরণবিধি গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে আহ্বান জানায়।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইং থুখার কাছে মন্তব্য চেয়ে আরএফএ যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।
এদিকে, রাখাইনের পায়াকতাউ টাউনশিপের একটি শিবিরে আশ্রয় নেয়া পাঁচ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা খাদ্যসহায়তা না পাওয়ার কারণে চরম সংকটে রয়েছে। শুক্রবার তারা আরএফএকে জানিয়েছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা কোনো সহায়তা পায়নি।
পায়াকতাউয়ের আহ নউক ইয়ে গ্রামের এক শিবিরের বাসিন্দা জানিয়েছেন, খাদ্যসংকটের কারণে বাস্তুচ্যুতরা চালের পাতলা ভাত খেয়ে বেঁচে আছে। ওই বাসিন্দা বলেন, ‘শিবিরে শুকনো চাল অত্যন্ত জরুরি। কারণ, কিছু বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি অনাহারে ভুগছে। আমাদের কোনো কাজ নেই এবং অন্যদের কাছ থেকে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাড়তি দাম আমাদের পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলছে।’
শিবিরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরে এক গর্ভবতী নারী, এক বৃদ্ধ ও এক শিশু চিকিৎসা, ওষুধের অভাবে এবং অপুষ্টির কারণে মারা গেছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় কার্যালয় জানিয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাখাইন রাজ্যে তাদের মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ সীমিত করেছে।
এছাড়া স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোকেও বাধা দেয়া হয়েছে। নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি সতর্ক করে বলেছে, মার্চ ও এপ্রিল মাসে রাখাইন রাজ্যে প্রায় ২০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে পড়তে পারে, কারণ পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নেই।
রাখাইন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ও জান্তার মুখপাত্র হ্লা থেইনের কাছে খাদ্যসংকট নিয়ে আরএফএ মন্তব্য চাইলেও শুক্রবার পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।