বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৮০ বছর বয়সে পা রেখেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, চোখের সমস্যা ও হৃদরোগে ভুগছেন। এছাড়া তার মেরুদণ্ড, ঘাড়, হাত, হাঁটুর সমস্যাসহ আরো কিছু শারীরিক জটিলতা আছে। এছাড়া তিনি পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য আগামীকাল ৭ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডন যাচ্ছেন। তবে একদিন পিছিয়ে ৮ জানুয়ারিও হতে পারে তার এ যাত্রা। তবে এ সপ্তাহেই তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে। লন্ডন থেকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাবেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম ও আত্মীয়-স্বজনসহ ১৮ সদস্যের সহযোগী দল সঙ্গে যাওয়ার কথা রয়েছে। নানা জটিল রোগসহ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিতে দীর্ঘদিনের দাবি ছিল বিএনপি ও জিয়া পরিবারের। এরই মধ্যে বহুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে। তবু বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে একরকম চিকিৎসাবঞ্চিত করে রাখে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। তার পরই তার লন্ডনে যাওয়ার বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে কয়েকবার বিদেশযাত্রার দিনক্ষণ ঠিক হলেও বিভিন্ন কারণে তা বাতিল হয়েছে। অবশেষে ৭ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। এতে বলা হয়, খালেদা জিয়ার সঙ্গে ৭ জন চিকিৎসকসহ ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যাবে। যার মধ্যে রয়েছেন- খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান।
জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়াকে ৭ জানুয়ারি রাত ১০টা কিংবা তারও পরে একটি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স উড়োজাহাজে করে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন চিকিৎসকরা। আধুনিক সুযোগসুবিধা সংবলিত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সাবেক প্রধানমন্ত্রী লন্ডন যাবেন। দীর্ঘ এ যাত্রায় তার সঙ্গে থাকবেন চিকিৎসক, পরিবারের সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা। জানা গেছে, খালেদা জিয়া প্রথমে যাবেন ছেলে তারেক রহমানের কাছে। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে। ম্যারিল্যান্ডের পূর্ব বাল্টিমোরে অবস্থিত জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এর আগে ৩০ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, বেগম জিয়ার লন্ডনে যাওয়ার তারিখ সুস্পষ্টভাবে বলতে পারব না। কারণ ওনার শরীর মাঝেমধ্যেই একটু খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।
বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘ম্যাডাম বিদেশ যাবেন এটা ঠিক আছে। তবে সেটা ৭ জানুয়ারিও হতে পারে, আবার ৮ জানুয়ারিও হতে পারে।’
সূত্রমতে, এর আগে চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন খালেদা জিয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। এমিরেটস এয়ারলাইনসের ই-কে ৫৮৭ ফ্লাইটে স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে দুবাই বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ এ অবতরণ করেন।
তার যাত্রাবিরতির খবরে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপি নেতারা বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। ১৬ জুলাই বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বেগম জিয়া লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে মা-ছেলের এ সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়েই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে গন্তব্যে নিয়ে যান। সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের সফরসঙ্গী হিসেবে তার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার ও গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগম ছিলেন। লন্ডন থেকে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর দেশে ফিরে ২৯ অক্টোবর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেখতে যান খালেদা জিয়া।
সূত্রমতে, খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। তখন থেকে তিনি গুলশানের ফিরোজা বাসায় অবস্থান করছেন। এরপর থেকে তার দণ্ডাদেশ স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হয়। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। তার পরই তার লন্ডনে যাওয়ার বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এসময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮০ দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে ওঠে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ২০০১ সালে ফের ক্ষমতাসীন হয় খালেদা জিয়ার সরকার। একপর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে বিএনপি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারেনি।