দেশজুড়ে গ্যাস সংকট চরমে পৌঁছেছে। বাসাবাড়ি, কারখানা ও সিএনজি স্টেশনসহ সর্বত্রে গ্যাস সংকটে প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষ। ভোগান্তি নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের। তবে, সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান তিতাস বলছে, শীতের প্রকোপে গ্যাস লাইনে কনডেনসেট জমে। একইসঙ্গে গ্যাস সরবরাহ কমায় সংকট তীব্র হয়েছে।
শীতের মৌসুমে বাসাবাড়ি ও কারখানায় গ্যাসের লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় সংকট তৈরি হয় কিন্তু রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) স্টেশনগুলোতেও শীত কিংবা গরম সব সময়ে গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকছে গাড়ির দীর্ঘ সারি। এতে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়। গ্যাস সংকটে কারখানায় উৎপাদন কমায় লোকসান গুণতে হচ্ছে।
গ্যাস সংকট নিরসনের বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জ্বালানি মানুষের চালিকা শক্তির প্রাণ। জ্বালানি সংকট বিগত ১৫ বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা। সেই সমস্যা নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকার উপলব্ধি করেছে। আমরা অপেক্ষা করি, আগামী শীতে যেন গ্যাস সংকট না হয়। এই মুহূর্তে নতুন সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) কাছে এছাড়া বলার কিছু নেই।
তিনি আরো বলেন, বিগত ১৫ বছরে জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা বাড়ায় দেশজুড়ে গ্যাস সংকট চরমে পৌঁছেছে। জ্বালানি সংকট নিরসনে আমদানির পাশাপাশি নিজস্ব উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দা কাজল সরকার বলছেন, বাসায় গ্যাসের লাইন থাকার পরেও সিলিন্ডার গ্যাসে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। কারণ প্রতিদিন সকাল ৮টায় লাইনের গ্যাস চলে যায়। আসার ঠিক নেই। এখন পানি ফুটিয়ে খাওয়ার মতোও পরিস্থিতি নেই। গ্যাসের চাপ কম থাকায় ডাল বা ভর্তা রান্না করতে হয় বেশি। মাছ বা মাংস রান্না করার মতো অবস্থা নেই। শুধু বাসাবাড়িতেই নয়, রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ নেই। তাই গাড়ির জ্বালানি সংগ্রহে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে চালকদের। তার পরও চাহিদামতো সিএনজি কিনতে পারছেন না অনেকেই। সিএনজি চালকরা বলছেন, গ্যাস সংগ্রহের জন্য তিন থেকে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় লাইনে দাঁড়িয়ে। তার পরও ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যায় না। গ্যাসের চাপ কম থাকায় সিএনজি চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ছে, এতে আয় কম হওয়ায় পরিবারের কষ্ট বেড়েছে।
ডেমরায় অবস্থিত মাতুয়াইল রাজধানী সিলিং স্টেশন কর্তৃপক্ষের মতে, গ্যাসলাইনে পাউন্ড-বল প্রতি বর্গ ইঞ্চি (পিএসআই) অন্তত ১৫ থাকার কথা, এর থেকে অনেক কম থাকার কারণে মেশিন প্রায় অচল থাকছে। রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ ১২ জেলায় তিতাসের গ্রাহকরা দৈনিক প্রায় ১৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস পেত। এখন মিলছে দেড়শ’ কোটি ঘনফুটের নিচে। একটি ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল মেরামতের কাজ চলায়, আমদানির গ্যাস কমেছে বলে জানান তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে মহাসচিব ফারহান নূর আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শীতের প্রকোপে গ্যাস লাইনে কনডেনসেট জমে এতে গ্যাস সরবরাহ কমে। সেজন্য সংকট তীব্র হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ওঠাণ্ডনামা করে, এ কারণে গ্যাসের সংকট চরম হয়। স্থায়ীভাবে গ্যাস সংকট নিরসনে আমাদের নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে। এরইমধ্যে পুরোনো গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদ ফুটিয়ে আসছে, নতুন করে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারে জোর দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিগত সরকারের আমলে কমিশন বাণিজ্যের জন্য এলএনজি আমদানি নির্ভর করেছে। এতে কমিশন বাণিজ্যের টাকা কুচক্রিমহলের পকেট ভারি হলেও দেশের নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের আবিষ্কার করা হয়নি। বিতরণ সংস্থা ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের’ পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এলএনজি টার্মিনাল মেরামতের কারণে গ্যাস সরবরাহ কমে আসায় ‘কিছু এলাকায়’ সংকট তীব্র হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একাধিক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, তাদের তিতাসের লাইনে গ্যাস সরবরাহ বৃহস্পতিবার প্রায় সারা দিন বন্ধ ছিল। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে বনশ্রী, মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বাসাবো ও আজিমপুরের বাসিন্দাদের। ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের পেছনের এলাকার বাসিন্দা রাম চন্দ্র বলেন, গত নভেম্বর থেকে গ্যাস সংকট বেড়েছে। ভোর থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত লাইনের গ্যাসে রান্নাই করা যায় না। একই অবস্থার কথা জানান টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা লিজা আক্তার। তিনি বলেন, তিন-চার মাস ধরে তাদের লাইনে গ্যাস নেই বললেই চলে। গার্মেন্টসের কাজ শেষ করে রাত ১২টায় বাসায় ফিরলেও লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্না করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। আগে গভীর রাতে কিছুটা গ্যাস পাওয়া যেত, অনেকে রাত জেগে রান্না করতে পারতেন। এখন গ্যাস একেবারে উধাও। মাসে মাসে গ্যাসের বিল দিচ্ছি, আবার সিলিন্ডারও কিনছি।
মিরপুর এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, আগে দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ কম থাকত। এখন ভোর থেকেই গ্যাস থাকে না। ফলে দিনের রান্নাগুলো ভোরের আগেই শেষ করতে হয়। বাসাভাড়ার সঙ্গে গ্যাসের বিলও দিতে হয়। এর চেয়ে বরং যারা সিলিন্ডার গ্যাসের বাসায় ভাড়া থাকেন, তারাই ভালো আছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, লাইনের গ্যাসের সংযোগ থাকার পরও অনেক বাসায় বাড়তি এলপিজির সিলিন্ডার রাখতে হচ্ছে।
ঢাকা অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ নেওয়াজ পারভেজ বলেন, তিতাস এলাকায় প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। টার্মিনাল মেরামতের কারণে তা ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কমে এসেছে। সে কারণে কিছু এলাকায় সংকট তীব্র হয়েছে। ঢাকায় গ্যাসের সমস্যা তো বহুদিনের। কিছু এলাকায় চাহিদা মতো গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আবার কিছু এলাকায় লাইনে সমস্যা আছে। ফলে বেশি চাপে গ্যাস দেয়া যায় না। আমরা একেকটি অঞ্চল ধরে লাইন মেরামতের চেষ্টা করছি।