ঢাকা ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চিকিৎসার জন্য লন্ডনে খালেদা জিয়া

* সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানাতে গুলশান ও বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ঢল * দীর্ঘদিন পর জিয়া পরিবারের পুনর্মিলন * যেভাবে মিলল বিদেশ যাওয়ার সুযোগ * যা আছে ‘লন্ডন ক্লিনিকে’
চিকিৎসার জন্য লন্ডনে খালেদা জিয়া

উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কাতারের আমিরের পাঠানো ‘বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ কাতারের রাজধানী দোহা হয়ে লন্ডন পৌঁছাবেন তিনি। সেখান থেকে তাকে সরাসরি যুক্তরাজ্যের লন্ডন ক্লিনিকে নেয়া হবে। সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার পরবর্তী চিকিৎসা চলবে। লন্ডন বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে রিসিভ করবেন তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও স্ত্রী ড. জোয়াবেদা রহমান এবং লন্ডন বিএনপির দুজন নেতা। আর ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে চিকিৎসকদের পাশাপাশি তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি যাবেন। এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টায় গুলশানের বাসা থেকে তিনি বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হন। তার বিদায় উপলক্ষে বিকাল থেকেই গুলশানে ‘ফিরোজা’র সামনে ভিড় করেন নেতাকর্মীরা। আশপাশের রাস্তাগুলোতেও নেতাকর্মীদের ঢল নামে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে ‘ফিরোজা’য় যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও সেখানে যান। নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর ছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরাও।

এর আগে গত সোমবার রাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একটি নির্দেশনার কথা জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) রাত ৮টায় তার গুলশানের বাসা থেকে ঢাকার হজরত শাহ্?জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রওয়ানা হবেন। রাত ৯টায় তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। রাত ১০টায় কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তিনি ঢাকা ছেড়ে যাবেন। এ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর (উত্তর ও দক্ষিণ) বিএনপি এবং সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেশনেত্রীকে বিদায় জানানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। যাতে রাস্তায় যানবাহন ও পথচারী চলাচলে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের যথাযথভাবে নির্দেশনা মেনে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে।

খালেদা জিয়াকে বহনকারী কাতার আমিরের বিশেষ বিমান রয়েল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছায়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিবারের সদস্য ছাড়া চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সফরসঙ্গী হবেন মোট ১৬ জন। যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি থাকবে।

জিয়া পরিবারের পুনর্মিলনের অপেক্ষা : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে মারা যাওয়ার পর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে আগলে রেখেই দিন কাটে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে এসে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালিয়েছেন তিনি। তবে আলোচিত এক এগারোর সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে মহাবিপদের মধ্যে পড়ে জিয়া পরিবার। দুই ছেলের একজন বিদেশে থাকতেই মারা যান। বড় ছেলে তারেক রহমান ২০০৭ সাল থেকে পরিবারসহ চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন লন্ডনে। লম্বা বিরতির পর ২০১৭ সালে একবার মা-ছেলের সঙ্গে দেখা হলেও গত সাড়ে সাত বছর কেটেছে ভার্চুয়াল কথাবার্তার মধ্য দিয়ে। এবার চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। আজ বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশটিতে পৌঁছার পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাকে বরণ করে নেবেন তারেক রহমান।

রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও আলোচনায় দীর্ঘ সময় পর জিয়া পরিবারের আসন্ন পুনর্মিলনীর কথা। এরইমধ্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে জিয়া পরিবারের জীবিত সদস্যদের গ্রুপ ছবি আবেগঘন ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ কল্পনার রাজ্যে ছবি আঁকছেন কেমন হতে পারে পুরো পরিবারের মিলনমেলা।

লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে আগে থেকেই অবস্থান করছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান। খালেদা জিয়ার সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে তার ছোট ছেলে কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথিও লন্ডন যাবেন। কোকোর দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমানও লন্ডনে আছেন। তাই লন্ডনে পুরো জিয়া পরিবারের সবাইকে এক ফ্রেমে দেখা যাবে।

এদিকে বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎকালে সুস্থভাবে যেন দেশে ফিরে আসতে পারেন সেজন্য দোয়া চেয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন খালেদা জিয়া। দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি শেষে ১৬ জুলাই তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সে সময় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং যুক্তরাজ্য বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। লন্ডনে সাক্ষাৎকালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান উভয়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারেক রহমান তখন নিজের গাড়িতে করে মা খালেদা জিয়াকে গন্তব্যে নিয়ে যান।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে যাচ্ছেন যারা : খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিবারের সদস্য ছাড়া চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সফরসঙ্গী হয়েছেন মোট ১৬ জন। যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি ছিল।

বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ জানান, আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের রাজকীয় কাতারের চারজন চিকিৎসক এবং প্যারা মেডিকসরা থাকবেন। ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের ছয়জন সদস্য এই বিমানে যাবেন। তারা হলেন অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিক, অধ্যাপক নূরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন।

এছাড়া খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ছোট ছেলের স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এসবের মধ্যে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগকে সবচেয়ে ঝুঁকির কারণ মনে করেন তার চিকিৎসকরা।

যেভাবে মিলল বিদেশ যাওয়ার সুযোগ : নানা রোগে আক্রান্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজা। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে কারাগারে যেতে হয় খালেদা জিয়াকে। তার শারীরিক অসুস্থতা ও বয়স বিবেচনায় বারবার জামিনের জন্য চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। মাঝে অসুস্থতা বাড়লে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে দেয়া হয় চিকিৎসা। দুই বছর পর করোনার সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কারামুক্তি দিলেও শর্তজুড়ে দেয় তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না।

নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে ফেরেন হুইল চেয়ারে। তখন থেকেই আবাসস্থল ফিরোজা এবং হাসপাতাল এভারকেয়ারে চিকিৎসা নিতেই সময় কাটে তার। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে ছয়বার আবেদন করা হয় বিদেশ চিকিৎসার জন্য। দলীয়ভাবে কর্মসূচিরও আয়োজন করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।

এক পর্যায়ে গুরুতর অবস্থা হলে বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে, পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে তার লিভারের চিকিৎসা দেয়া হয়। ওই সময়ও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা জার্মানির হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তির সুপারিশ করেছিল মেডিকেল বোর্ড।

৫ আগস্ট গণঅভুত্থানের পর মুক্ত হন খালেদা জিয়া। আইনি প্রক্রিয়ায় তার সাজা বাতিল করেন আদালত। তখন থেকেই কথা হচ্ছিল, এখন আর কেন দেরি করা হচ্ছে বিদেশে চিকিৎসার জন্য। জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার জন্য তার শারীরিক অবস্থাসহ নানা প্রস্তুতি নিতে সময় লেগেছে।

যা আছে ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন ক্লিনিক। এরপর থেকেই মানুষের মধ্যে কৌতূহল দেখা গেছে শত বছরের পুরোনো এই বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে। ব্রেস্ট, ইউরোলজি, গাইনোকলজি ও চর্মরোগ চিকিৎসায় সুনাম রয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্রটির। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন ও সেলুলার থেরাপিতেও রয়েছে সুনাম।

১৯৩২ সালে যাত্রা শুরু করা হাসপাতালটির অবস্থান সেন্ট্রাল লন্ডনের ডেভনশায়ার প্লেস ও মেরিলিবন সড়কে। এটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে পরিচিতি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, লন্ডন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়ামের স্ত্রী প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথরিন, রাজা তৃতীয় চার্লস, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, তার স্বামী ফিলিপ অব এডিনবরা। এছাড়া, এ হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন।

লন্ডন ক্লিনিকের রোগীর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও ব্রিটিশ-আমেরিকান অভিনেত্রী লিজ টেইলরও। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের অনেক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতালটির ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রশংসা করে থাকে ইউরোপের বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। লন্ডন ক্লিনিকের বহির্বিভাগে প্রতি বছর গড়ে এক লাখ ১০ হাজার মানুষ চিকিৎসা নেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন ২৩ হাজার রোগী।

প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই লন্ডন যান খালেদা জিয়া। ওই সময় সেখানে একটি ঈদও উদযাপন করেন তিনি। সেইবার খালেদা জিয়াকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাসায় নিয়ে যান তারেক রহমান। তার সেই সফরে লন্ডনের মরফিন্ড আই হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চোখের অপারেশন করানো হয়েছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত