ঢাকা ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসির চ্যালেঞ্জ

ইসির চ্যালেঞ্জ

ভোটার তালিকা হালনাগাদে আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। চলবে ২ সপ্তাহব্যাপী। এবার বাড়ি বাড়ি ভোটার করতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। তবে আগের বছরগুলোতে অর্থ না থাকায় বাড়ি বাড়ি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা থেকে বিরত ছিলো ইসি। এবার অর্থের অভাব হবে না। দেড়শ’ কোটির উপরে বাজেট হতে পারে বালে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা যায়, ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি অথবা এর আগে যাদের জন্ম তাদের ও বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে যারা বাদ পড়েছেন তাদের তালিকাভুক্তি এবং মৃত ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে কর্তনের জন্য তথ্যাদি সংগ্রহ করা হবে।

নির্বাচন কমিশনের পরিচালক (জনসংযোগ) শরীফুল আলম বলেন, আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ এবং মৃত ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তনের তথ্যাদি সংগ্রহ করবেন।

এসময়ে তথ্য সংগ্রহকারী ও সুপারভাইজাররা ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি ও কর্তনের জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি সংগ্রহ করবেন।

আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত নিবন্ধন কেন্দ্রে নিবন্ধন (বায়োমেট্রিক গ্রহণসহ) করা হবে। এ সময়ে ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে যাদের জন্ম অথবা বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে বাদ পড়েছেন তাদের নিবন্ধন করা হবে।

উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে ভোটার এলাকা স্থানান্তরের আবেদন গ্রহণ, মৃত ভোটারদের নাম কর্তনের তথ্যাদি এবং নতুন ভোটারের তথ্য বাংলাদেশ ভোটার রেজিস্ট্রেশন সফটওয়্যার (বিভিআরএস) সফটওয়্যারের সাহায্যে ডাটা এন্ট্রি ও ডাটা আপলোড করা হবে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে।

আগামী ৫ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ কর্তৃক খসড়া ভোটার তালিকার পিডিএফ প্রস্তুত ও সিএমএস পোর্টালে লিংক সরবরাহ করা হবে। এদিকে হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছে ইসি। আগামী ২ মার্চ চূড়ান্ত হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করা হবে। তার আগে ২০ জানুয়ারি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করবে ইসি। তবে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নে স্থানান্তরিত ও ভাসমান ভোটারদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে ইসি। পাশাপাশি স্থানীয় ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। ইসি সূত্র জানায়, বিগত ১৫ বছরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নানা অভিযোগ ও বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কের বাইরে নয় ভোটার তালিকাও, যেখানে নানা ধরনের ভুলের পাশাপাশি ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে চায় ইসি। তার অংশ হিসেবে শুরুতেই নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন। সেক্ষেত্রে ১২ কোটি ভোটারের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

তবে স্বচ্ছ ও নির্ভুল ভোটার তালিকা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ভোটার তালিকা হালনাগাদ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় উঠে এসেছে।

পরিকল্পনায় ১১টি বিষয়কে সঠিক, স্বচ্ছ ও নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে স্থানান্তরিত ও ভাসমান ভোটারদের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অনেক ভোটার বর্তমান ঠিকানায় না থেকে প্রয়োজনে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় ও হালনাগাদ তথ্য নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর ভাসমান নাগরিকরাও যখন যেখানে প্রয়োজন, সেখানেই চলে যান। তাদের অবস্থান ও ঠিকানা কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে ভোটার তালিকায় ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা রয়েই যায়।

ভোটার তালিকা করার সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করে থাকেন। তারা নানা ধরনের প্রভাব বিস্তার করে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোটার হওয়ার অযোগ্য ব্যক্তিকেও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাপ দিয়ে থাকেন। আর কমিশনের পক্ষে নিয়োজিত মাঠকর্মীদের অনেক সময় সেই চাপের কাছে অসহায় হতে হয়। ফলে রাজনৈতিক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপকে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করছে কমিশন।

ইসি সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে নারী ভোটাররা তাদের সঠিক তথ্য প্রদান করতে অনীহা দেখান। এছাড়া মৃত ভোটারদের তথ্যও দিতে চায় না অনেকে। এসব তথ্য পরিপূর্ণ না হলে ভোটার তালিকায় ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা রয়েই যায়। ফলে এসব বিষয়কেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে কমিশন। পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থা, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দক্ষ জনশক্তির অভাব, সঠিক ও মানসম্পন্ন তথ্যের অভাব, নিবন্ধন কেন্দ্রের দুর্বল অবকাঠামো, সীমিত সময় ও সম্পদ, সচল যন্ত্রপাতির অভাব এবং সর্বোপরি মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে যানবাহন সংকটকে ভোটার তালিকা প্রণয়নে চ্যালেঞ্জ মনে করছে সংস্থাটি।

সূত্র আরো জানায়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল হিসেবে ৫২০ জন রেজিস্ট্রেশন অফিসার, ৫২০ জন সহকারী রেজিস্ট্রেশন অফিসার, ৫৫ হাজার তথ্য সংগ্রহকারী, ১১ হাজার সুপারভাইজার, টিম প্রতি একজন টিম লিডার, প্রতি উপজেলায় একজন করে টেকনিক্যাল সাপোর্টার, টিম প্রতি পাঁচণ্ডছয়জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, টিম প্রতি দু-তিনজন প্রুফ রিডার ও টিম প্রতি একজন করে হেলপারের কথা বলা হয়।

এছাড়া পরিকল্পনায় নতুন ভোটার নিবন্ধনে এক বছরের তথ্য সংগ্রহে সম্ভাব্য ৪৫ লাখ ভোটারের ক্ষেত্রে ১২৫ কোটি টাকা ও সাত মাস সময়, দুই বছরের তথ্য সংগ্রহে সম্ভাব্য ৭৫ লাখ ভোটারের ক্ষেত্রে ১৬০ কোটি টাকা ও আট মাস সময় এবং তিন বছরের ক্ষেত্রে ১ কোটি ১০ লাখ ভোটারের জন্য ১৯৫ কোটি টাকা ও ৯ মাস সময় লাগতে পারে বলে ধরা হয়।

গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে নতুন ভোটার হয়েছেন ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন। সে হিসেবে ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন। ভোটার বাড়ার হার ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ভোটার তালিকার পরিসংখ্যান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ভোটার তালিকা বিতর্কিত হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে কমিশন। এজন্য তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

তিনি বলেন, এ কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শুদ্ধ ভোটার তালিকা ছাড়া কনফিডেন্ট মনে করছি না। এজন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাই করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে ভোটার তালিকাকে যে বিতর্কিত বলছি, আমরা শুদ্ধতার অভাব বলছি, এটি মূলত তিনটি কারণে হচ্ছে। প্রথম কারণ মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়া; দ্বিতীয়ত, দ্বৈত ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা; আর তৃতীয়ত, বিদেশি নাগরিক প্রতারণার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হয়েছেন কি না তা যাচাই করা।

এই ইসি আরো বলেন, আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি তথ্য সংগ্রহ করতে যান, সেখানে স্থানীয় কোনো ব্যক্তি আমাদের সহায়তা করেন, যেখানে দেখা যায় নিজের ভোটার যারা আছে, তাদের বয়স বাড়িয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। আবার দেখা যায়, অন্য কারো ১৮-১৯ বছর হলেও ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে দেন না। এর বাইরেও আরো অনেক ধরনের কারণ আছে। তবে এগুলো মূল।

এর আগে গত ২০২২ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১০৬ কোটি ৬৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে তার আগের বছরের চেয়ে হালনাগাদের ২০২২ সালে ২৬ কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়।

ইভিএম বাদ, ভোট হবে ব্যালটে : আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং (ইভিএম) পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ব্যালটে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন বলেন, জাতীয় নির্বাচন ইভিএমে নয়, ব্যালটে হবে ।

জানা যায়, ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, খরচ হয় ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। বরাদ্দ থেকে অবশিষ্ট ছিল ১১৬ কোটি টাকা। আর সেই টাকায় প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়াতে গত বছরের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে ইসি। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ কওে দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। এর মধ্য দিয়ে বাতিল হয় ইসির ইভিএম প্রকল্প।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত