চালের দামে ক্ষুব্ধ মানুষ

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যবসায়ীদের চাল আমদানিতে শুল্কছাড় ও আমনের ভরা মৌসুমে বাজারে দফায় দফায় বেড়েছে চালের দাম। এতে ক্ষুব্ধ নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ী ও মিলার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে স্বয়ংসম্পন্ন চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে চিকন চাল সর্বোচ্চ ৮৫-৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে মৌসুমেও চাল কিনতে বিড়ম্বনায় পড়েছেন ভোক্তারা।

দেশের মানুষের খাদ্যের প্রধান উপকরণ চালের দামের অস্থিরতার লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। শুল্কছাড়ের চাল আমদানি, অন্যদিকে আমনের ভরা মৌসুম বাজারে চালের যোগান বেড়েছে কয়েকগুণ। এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, সাময়িক মজুতদারির জন্য চালের বাজার অস্থিতিশীল। মনিটরিং করা হচ্ছে। খুব শিগগির চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশাবদ ব্যক্ত করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আপাতত চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। এখন ধান-চালের ভরা মৌসুম, কৃষকের ঘরে উঠেছে আমন ধান। তারপরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই চাল কিনে খেতে হচ্ছে। তাদের মতে, চালের দাম এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, আগে যেসব ক্রেতারা চিকন চাল কিনতেন তারা এখন বাধ্য হচ্ছেন মোটা চাল কিনতে। একপ্রকার জোর করে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের। সরকার ভারত থেকে চালে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৬ জানুয়ারি এক মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৬ হাজার ৫৯৬ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুমোদন দেয় তিন লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির। পরে তা বাড়িয়ে চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি করা হয়েছে।

উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়া, হাট-বাজার-সড়কে অব্যাহত চাঁদাবাজি, আমদানি করা চাল না আসা, সরকারের সংগ্রহ টার্গেট ফেল করা, কয়েক স্তরে হাতবদল, সরকারি মজুত কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বেড়েইে চলেছে চালের দাম। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ও চালের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে চিকন চালের কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছে। চিকন চাল ছাড়াও মধ্যবিত্তের একমাত্র ভরসার মোটা জাতের চালের দামেও লেগেছে বাড়তি দামের হাওয়া। ব্যবসায়ীদের দাবি, যদিও বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে চালের দাম কম ছিল। কিন্তু বাজারে চালের সংকট না থাকলেও মিলপর্যায়ে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা দাম বাড়িয়েছে মিলমালিকরা। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর প্রভাবে চালের বাজারে দামের অস্থিরতা বেড়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, চালের দামের ব্যবধান গড়েছে অন্তত ৮ থেকে ১০ টাকা। ১০ থেকে ১৫ দিন আগে প্রতি কেজি সরু চালের দাম ছিল ৭৫ টাকা, যা বর্তমানে ৮২ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের পর সব থেকে বেশি দামের পরিবর্তন হয়েছে নাজিরশাইল চালের। দুই সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি নাজিরশাইল ছিল ৭০ থেকে ৭৮ টাকা। তবে গতকাল তা ৭৬ থেকে ৮৬ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ প্রতি কেজি নাজিরশাইলের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকটি মাফিয়া কোম্পানির কবজায় দেশের চালের বাজার। গেল তিন মাসের কয়েক দফায় এসব গ্রুপের কারসাজিতে প্রতি বস্তা সরু জাতের চালের দাম বেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

কারওয়ান বাজারের চালের পাইকারি ব্যবসায়ী ও নোয়াখালী রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী শাওন আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, বর্তমানে বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। একদিকে আমদানি করা চালের সরবরাহ বেড়েছে। অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর মজুদ রয়েছে পর্যাপ্ত। তবুও কেন চালের দাম বাড়ছে এর কোনো উত্তর নেই।

এদিকে আগে থেকেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মধ্যবিত্তের চাহিদার শীর্ষে থাকা মোটা জাতের চাল। ভরা মৌসুমে ব্রি-২৮, স্বর্ণা, ও পাইজাম জাতের চালের দাম কমার কথা থাকলেও এখনো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়, গুটি স্বর্ণা চাল কিনতে ক্রেতাদের খরচ করতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। এছাড়া বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি পুরোনো আটাশ ৬৫, পাইজাম ৬০, কাটারিভোগ ৮৫, বাসমতি ৯৪ থেকে ৯৮, পোলাওর চাল ১২০ থেকে ১২৫ ও আমন ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর আগে গত বছর নভেম্বরে চাল আমদানির ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রেখে বাকি আমদানি শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে এনবিআর। তবুও আমদানি করা চালের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। আমদানি করা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকার ওপর।

জুরাইন বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা মনির হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৫ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ৭৫ টাকা ছিল। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০-৮৬ টাকা, যা আগে খুচরা পর্যায়ে ৭০-৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকা, যা আগে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি মাঝারি আকারের চালের মধ্যে বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের সরকারি সংস্থাগুলো যে স্তরে অভিযান পরিচালনা করার কথা সে স্তরে তারা অভিযান পরিচালনা করছেন না। দায়সারাভাবে নামমাত্র খুচরা বাজারগুলোতে অভিযান চালায় সংস্থাগুলো। ফলে কারসাজি করা ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে ফুলেফেঁপে উঠছে। অন্যদিকে বরাবরই দেশের কৃষক ও ভোক্তা ঠকে আসছেন। দ্রুতই এ সংস্কৃতির প্রতিকার করা জরুরি। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ার দায়িত্ব মূলত প্রতিযোগিতা কমিশনের। কিন্তু তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তারা নিজেরাই বাজার থেকে হারিয়ে গেছে। সরকারের বাজার মনিটরিং সংস্থাগুলোর তদারকি নিয়ে সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, বাজারে একাধিক সংস্থা তদারকি করে। কিন্তু ভোক্তা এ থেকে কোনো সুফল পাচ্ছে না। পণ্যের দাম বাড়লেই কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু যে স্তরে কারসাজি হয়েছে, সেই স্তরে মনিটরিং হয় না। ফলে অসাধুরা এ সুযোগে ভোক্তাকে বেশি করে নাজেহাল করে তোলে। তার ভাষ্য, প্রায় দুই মাস পরই রোজা শুরু হবে। এখন থেকেই যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো না হয়, ক্রেতারা আরো ভোগান্তিতে পড়বে। বাংলাদেশ গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট, আগস্ট-২০২৪ শীর্ষক বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে বন্যায় ধানের ব্যাপক ক্ষতির কারণে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চালের উৎপাদন ৩ শতাংশ কমতে পারে। এই অর্থবছরে চালের উৎপাদন ৩ কোটি ৬৮ লাখ টন হতে পারে। ধান হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ শতাংশ কম। বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ টনের বেশি।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে ধানসহ চালের দাম বেড়েছে। সরকারি ভাষ্যমতে সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন খরচ বেড়েছে, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। বেড়েছে কৃষি যন্ত্রপাতির দাম। বেড়েছে সার, কীটনাশকের দামও। আরো বেড়েছে খেতে পানি সরবরাহ দেয়ার ডিজেল-কেরোসিন ও বিদ্যুতের দাম। তাছাড়া সার্বিকভাবে বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে। কারণ কৃষককে ধান বা চাল বিক্রি করেই সারা বছর জীবন চালাতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই বাজার থেকে যখন বেশি দাম দিয়ে চাল ছাড়া অন্য পণ্য কিনবে, তখন সেসব পণ্য কেনার অর্থ ওই কৃষককে ধান ও চাল বিক্রি করেই উপার্জন করতে হবে। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও কমেনি চাঁদাবাজি। হাতবদলের পরে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে চাঁদাবাজরা। যার প্রভাব পড়ছে বাজারগুলোতে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে চালের দাম। হাসিনা সরকারের পতনের পর মাসখানেক বন্ধ থাকলেও চাঁদাবাজরা ভোল পাল্টে আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে। এ কারণে চালসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যই চড়া দামে বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়ে। জানা গেছে, আমন মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে বলেই বাজারে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম হওয়ার গুজবে বেড়েছে চালের দাম। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমন সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৪৭২ টন। এর মধ্যে ধান ৭ হাজার ৯৬১ টন। সিদ্ধ চাল ২ লাখ ১০ হাজার ৫৪১ টন ও আতপ চাল ৩৩ হাজার ৬৪০ মেট্রিক টন। একদিকে মজুত কমে যাওয়া, অপর দিকে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ কাঙ্ক্ষিত হারে না হওয়ার কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা আরো বলছেন, ‘চালের দাম এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, আগে যেসব ক্রেতারা চিকন চাল কিনতেন তারা এখন বাধ্য হচ্ছেন মোটা চাল কিনতে। একপ্রকার জোর করে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাদের।’ সরকার ভারত থেকে চালে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ৬ জানুয়ারি এক মাসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৬ হাজার ৫৯৬ টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুমোদন দেয় তিন লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির। পরে তা বাড়িয়ে চলতি মাসের ১৫ জানুয়ারি করা হয়েছে।

চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দামণ্ড এমনটাই বলছেন অটোরাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকদের মতে, ভারতে চালের দাম বেশি, এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। ভরা মৌসুমেও কম দামে চাল না কিনতে পেরে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। সীমান্ত অঞ্চলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় চালের মূল্য কমছে না বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা। বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর দুর্বলতার কারণে চালের দাম কমছে না।