ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাখির কারণে উড়োজাহাজে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার (ইনসিডেন্ট) হার হাজারে ১ দশমিক ৭৩, যা বৈশ্বিক হারের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। এমন একটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছে সম্প্রতি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) আয়োজিত মতবিনিময় সভার উপস্থাপনায়। এ মতবিনিময় সভায় পাখির আঘাতে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্কতার বার্তা দেয়া হয়েছে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, পাখির কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে বিমানবন্দর এলাকায় সবরকম প্রস্তুতিই নেয়া হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পরপর কয়েকটি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা পুরো অ্যাভিয়েশন খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে পাখির কারণে (বার্ড হিট) কোরিয়ায় জেজু এয়ারের অনিয়ন্ত্রিত বোয়িংটি রানওয়ের শেষপ্রান্তের দেয়ালে বিধ্বস্ত হলে ১৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরপর থেকে নিরাপদ আকাশের খোঁজ চলছে দেশে দেশে। এরই ধারাবাহিকতায় এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার ‘নিরাপদ আকাশের খোঁজে’ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বেবিচক। সেখানে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সেফটি নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তারা, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্তকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তব্য রাখেন।
সভায় নিজেদের উপস্থাপনায় বক্তারা উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার অনেকগুলো কারণ নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের আলোচনায় বারবারই কোরিয়ার জেজু এয়ারের ঘটনাটি উঠে আসে। দেশের বিমানবন্দরগুলোকে পাখির উৎপাতমুক্ত করা এবং বিমানবন্দরগুলোতে ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) যুক্ত করার ওপর জোর দেন তারা। ইউএস বাংলার হেড অব সেফটি ম্যানেজমেন্ট এ এ এম এম শামসুজ্জামান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) পরিসংখ্যান থেকে দেখান, বাংলাদেশের সবগুলো বিমানবন্দর মিলে বার্ড স্ট্রাইকের হার হাজারে ১ দশমিক ৭৩, এই হার বৈশ্বিকভাবে একের নিচে (দশমিক ৫০)।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যানটি করা হয়েছে। তার উপস্থাপনায় ৭ জানুয়ারি সকালে ধারণ করা ঢাকার হযরত শাহজালার বিমানবন্দরের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়। যাতে দেখা যায়, আকাশে অনেক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে, উড়োজাহাজ উড্ডয়ন বা অবতরণের ক্ষেত্রে যেগুলো ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
জেজু এয়ারের দুর্ঘটনার একটি ভিডিও দেখিয়ে শামসুজ্জামান বলেন, ল্যান্ডিং গিয়ার, ফ্ল্যাপ ছাড়াই উড়োজাহাজের অবতরণের ওই ভিডিও থেকে মনে হয় পাইলট উড়োজাহাজটির ওপর সবরকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন। যার কারণে উড়োজাহাজটি বেলি ল্যান্ডিং করার পর গতি কমাতে না পারায় সেটি রানওয়ের শেষ প্রান্তের দেয়ালে বিধ্বস্ত হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা একদম শহরের মাঝখানে, আর চারদিকে পাখিদের খাবারের অনেক উৎস থাকায় বিমানবন্দরকে পাখিমুক্ত রাখতে তাদের বেগ পেতে হয়।
তবে পাখি তাড়াতে তারা লেজার আলো ব্যবস্থা, সজোরে শব্দ করে পাখি তাড়ানোর যন্ত্রসহ বিমান বন্দরে পাখি শনাক্ত করতে পারে এরকম বিশেষ ক্যামেরা বসানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে ১২৮ ডেসিবল শব্দ করে এমন সাউন্ডবার আছে, আছে গ্যাস ক্যানন। কামরুল ইসলাম বলেন, শব্দ করে পাখি তাড়ানোর জন্য আরো যন্ত্র আছে। আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই বেইজড) ক্যামেরা, যেগুলো পাখি শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে জানাতে পারে। পরে বিমান বন্দরের বার্ড শ্যুটারা সেদিকে গিয়ে পাখি তাড়াতে পারেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ পাখিদের মারতে না চাইলেও অনেক সময় উপায় না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, পাখি নিয়ে তারা কয়েকজন অধ্যাপককে যুক্ত করে একটি বিশদ গবেষণা কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। সেটি শেষ হলে হয়তো নতুন কোন উপায় পাওয়া যেতে পারে।
পাখি নিয়ে কাজ করা শেরে বাংলানগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ারুল হক বেগ বলছেন, বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা তৈরি করে মূলত বিভিন্ন ধরনের চিল। ঢাকার আশপাশে এদের অনেক খাবারের উৎস থাকায় এগুলোকে নির্মূল করা সম্ভব না। তবে বিভিন্ন উপায়ে এই পাখিগুলোকে বিমানবন্দর থেকে দূরে রাখা নিয়ে তারা কাজ করছেন। জেজু এয়ারের দুর্ঘটনায় এতো প্রাণহানির আরেকটা বড় কারণ হিসেবে রানওয়ের শেষ প্রান্তের দেয়ালের কথা তুলে ধরে বক্তরা বলেছেন, সেটি না থাকলে উড়োজাহাজটি হয়তো আরো কিছুদূর ছেঁচড়ে গিয়ে থেমে যেত। এতে হতাহতের সংখ্যা আরো কম হত। তারা বলেন, দেশে দেশে এর মধ্যেই রানওয়ের শেষ প্রান্তের দেয়াল ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া কুয়াশা, বৃষ্টির সময়ের কম দৃশ্যমানতায় বিমানের অবতরণ নিয়ে ঝামেলায় পড়ার বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায়। বিমানবন্দরে ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম যুক্ত করার কথা বলেন তারা। বাংলাদেশের এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন হারুনুর রশীদ বলেন, তারা দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর তথ্যের ভিত্তিতে মতামত ও সুপারিশ দিয়ে থাকেন। কিছুদিন আগের একটি দুর্ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিআর উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়ার পর তারা গিয়ে দেখেন সেটির ল্যান্ডিং নোজ গিয়ার পিনটি ক্ষয়ে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। যার কারণে সেটি ঠিকমতো কাজ করেনি। তারা এটিআর উড়োজাহাজ অপারেট করা এয়ারলাইন্সগুলোকে এই পিনগুলোর যত্ন নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। এগুলোর সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এসব নিয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, বিমানবন্দরগুলো পাখিসহ বন্যপ্রাণীমুক্ত রাখার বিষয়ে তারা সবরকম উদ্যোগই নিয়েছেন। আর দেশের কোন বিমানবন্দরেরই রানওয়ের শেষপ্রান্তে দেয়াল নেই। দেয়াল আছে বিমানবন্দরের চারদিকে, তার আগে অনেকখানি খোলা জায়গা রয়েছে।
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল-এটিসিকে বলা হয়েছে, তারা আবহাওয়া এবং পাখির বিষয়ে যেন উড়োজাহাজগুলোকে আগে থেকেই স্পষ্টভাবে সতর্ক করে। আমরা মূলত সচেতনতা তৈরি ও ফ্লাইট সেফটির ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ তৈরির জন্য আজকের এই কর্মসূচিটি হাতে নিই।
বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘পাখিরা আকাশে উড়বেই। সেখানে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয় আমরা সাধ্যমতো সবরকম ব্যবস্থাই নিচ্ছি যেন দুঘটনা না ঘটে। তিনি মনে করেন, অবকাঠামো ছাড়াও উড়োজাহাজ ও পাইলটের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক বিষয় থাকতে পারে, যার কারণে দুর্ঘটনা হয়। কারিগরি বা পরিবেশগত বিষয় হতে পারে। এসব বিষয়ে কথা বলতে অংশীজনদের সঙ্গে বসার বিষয়টি তুলে ধরে মঞ্জুর কবীর বলেন, ‘এয়ারলাইন্সগুলো যেন এয়ারক্র্যাফটের মেইনটেন্যান্স, পাইলটদের ট্রেনিং, জরুরি অবস্থার ট্রেনিং, খারাপ আবহাওয়ায় ল্যান্ডিং ট্রেনিংসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে তাদের তদারকি বাড়ায় সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি।’
বিমানবন্দরে আইএলএস যুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইএলএস ক্যাটাগরি-২ এর সমস্ত লাইট লাগানো হয়েছে, যতো মেকানিক্যাল কাজ আছে সব আমরা শেষ করে ফেলেছি। এখন একটা সার্ভে এয়ারক্রাফটের অপেক্ষায় আছি আমরা। যেটা সার্ভে করে অ্যাসেস করে, সেটার জন্য আমরা ওয়েট করছি। আমরা দুই থেকে তিনবার ওপেন টেন্ডার করেও রেসপন্স পাইনি। আমরা চেষ্টা করছি তাদের আনার জন্য।’ কম দৃশ্যমানতায় ঢাকায় নামতে সমস্যা হলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরকে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে বলেছেন তিনি। মঞ্জুর কবীর বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব আমাদের সমস্ত ক্রু যারা আছে পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, কেবিন ক্রু প্রত্যেকে যেন তার তার জায়গা থেকে সচেতন থাকেন। এখানে যেমন আমরা উড়োজাহাজে জ্বালানি ভরার সময়ও সতর্ক থাকি, যেন কোনো দূষণ না ঘটে।’
বাংলাদেশে উচ্চহারে আকাশপথের যাত্রী বাড়ছে উল্লেখ করে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে যাত্রী সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ ছাড়াবে। সে জন্য প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত জনবল লাগবে। বেবিচক মিলনায়তনে সংস্থার চেয়ারম্যান মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ডেপুটি চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ইন্তেখাব হোসাইন ও নভোএয়ারের হেড অব সেফটি আশফাক-উর-রহমান খান।