শীত কমলেই লোডশেডিংয়ের আশঙ্কা
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জ্বালানি খাতকে টেকসই করার চেয়ে লুটপাটে বেশি ছিল। এতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা মুখ্য বিষয় থাকলেও সেদিকে যায়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল কয়লা, গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি বছরে শীতের মৌসুম শেষে গরম ও বোরো সেচে বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়বে কয়েকগুণ। জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বেন মানুষ।
জানা গেছে, শীতের মৌসুমে বাসা-বাড়ি ও কারখানায় গ্যাসের লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় সংকট তৈরি হয় কিন্তু রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) স্টেশনগুলোতেও শীত কিংবা গরম সব সময়ে গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকছে গাড়ির দীর্ঘ সারি। এতে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়। এভাবে চলতে থাকলে গরমের মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লে উৎপাদনের ঘাটতি দেখা গিলে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়বেন মানুষ। একইসঙ্গে বোরো মৌসুমে জমিতে পানি সরবরাহে বিঘ্ন তৈরি হবে।
এসব বিষয়ে গ্যাস সংকট নিরসনের বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জ্বালানি মানুষের চালিকা শক্তির প্রাণ। জ্বালানি সংকট বিগত ১৫ বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা। সেই সমস্যা নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকার উপলব্ধি করেছে। আমরা অপেক্ষা করি, আগামী জ্বালানির সংকট দূর হবে। এই মুহূর্তে নতুন সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) কাছে, এছাড়া বলার কিছু নেই।
বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, আগামী গরম মৌসুমে লোডশেডিং বাড়লে ভোগান্তিতে পড়বেন মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হবে। ব্যাহত হবে ধানের জমিতে সেচ কার্যক্রম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আগেভাগেই পরিকল্পনা করতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শীত কমলেই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে, এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি থাকলে ভয়াবহ লোডশেডিং হবে। আসন্ন রমজান ও বোরোর সেচের বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে এই আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশজুড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। আগামী মার্চ ও এপ্রিলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য উৎপাদন দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়াতে হতে পারে। সেজন্য দেশি-বিদেশি উৎপাদনকারীদের বকেয়ার পরিশোধ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবিকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির কর্মকর্তা বলেন, ভারতের আদানি পাওয়ারসহ দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বকেয়ার বড় একটি অংশ চলতি মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে আসন্ন রমজান ও বোরোর মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যদিও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আদানি পাওনা পরিশোধ আগের থেকে বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু চলমান বিলগুলো বকেয়া থেকে যাওয়ায় চাপ কমছে না। তাই সংস্থাটি বিদ্যমান বকেয়া পরিশোধ করা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাওনা পরিশোধের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ পেতে বকেয়ার বড় একটি অংশ পরিশোধ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পিডিবির তথ্যমতে ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে আদানি পাওয়ারের এবং দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়ার পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা। গত সপ্তাহে পাওনা অর্থ পরিশোধের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের দাবি খুব দ্রুত সময় পাওনা অর্থ পরিশোধ না করতে পারলে আসন্ন গরমে পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে না তারা। তাই আগামী রমজান ও বোরোর সেচের বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে ১০ দিনের মধ্যে অন্তত বকেয়া পাওনার অর্ধেক পরিশোধ করতে সরকারকে অনুরোধ করেছে।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত বলেন, পিডিবির কাছে এই মুহূর্তে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর বকেয়া আছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। চুক্তিতে ৪৫ দিনের মধ্যে পরিশোধের কথা থাকলেও ছয় মাসেও পরিশোধ করা হয়নি। এরমধ্যে অন্তত অর্ধেক বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হলে সময়মতো হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) আমদানি করা যাবে। এর চেয়ে দেরি হলে অনেক বেসকারি প্রতিষ্ঠান সময় মতো বিদুৎ উৎপাদনে যেতে পারবে না। ফলে রমজান ও বোরোর মৌসুমে সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে আদানির চিঠিটিতে বলা হয়েছে, পিডিবির অর্থ পরিশোধের ধরনের উন্নতি হলেও এসব অর্থ প্রদান এবং বর্তমান মাসিক বিলগুলো কোনোভাবে পরিশোধ করতে পারছে না। যে কারণে বিদ্যুৎ রপ্তানির বিলবাবদ বকেয়া ৭৭১ মিলিয়ন ডলারসহ মোট ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার আউটস্ট্যান্ডিং রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে পিডিবি উত্থাপিত চালান (ইনভয়েস) পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারেনি।
এদিকে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) অর্থমন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, সময়মতো বিদেশি সরবরাহকারীদের প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ না করা হলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, চিঠিতে এলএনজি আমদানির বাবদ ভর্তুকি বরাদ্দ থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়ার অনুরোধ করা করেছে।
পেট্রোবাংলা তাদের চিঠিতে আরো বলেছে, নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পরিশোধ করা না হলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় সরবরাহকারীদের এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির দরপত্রে সরবরাহকারীদের অংশগ্রহণ কমতে পারে।
পাশাপাশি বকেয়া দেরিতে পরিশোধের কারণে জরিমানা সুদ আরোপ হতে পারে।
তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিন উল আহসান বলেছেন, বর্তমানে বিপিসির কাছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো বকেয়া নেই। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা অর্জন করেছে বিপিসি। তাই তারা এবার প্রিমিয়াম কম ধরেছে। টেন্ডারে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এতে বিপিসির অনেক সাশ্রয় হবে।
স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছে বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেছেন, আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী)-দের বকেয়া দাবি করাটা স্বাভাবিক। আমি তাদের সাথে দেখা করব, কীভাবে অর্থ পরিশোধ করা যায়- এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব।