বাংলাদেশে দিন দিন নারী ও পুরুষ ভোটারের ব্যবধান বাড়ছে। এতে প্রতিবছর নারীর চেয়ে পুরুষ ভোটার বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। আর এর পেছনে ধর্মীয় অজুহাতসহ আটটি কারণ চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ চূড়ান্ত হালনাগাদ অনুযায়ী, দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। ২০২৪ সালের ২ মার্চের এ হালনাগাদ বলছে, তখন নারী ভোটার ছিল ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৪ হাজার ৬৪১ জন। আর পুরুষ ভোটার ছিল ৬ কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৭ জন। সে সময় নারীর চেয়ে ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৬ জন পুরুষ ভোটার বেশি ছিল।
চলতি বছরের হালনাগাদ শেষে খসড়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন, যা গত ২ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত তালিকা ২ মার্চ প্রকাশ করা হবে। এবারের তালিকা বলছে, দেশের ভোটার বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জনে। এর মধ্যে নারী ভোটার ৬ কোটি ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪১৫ জন। আর পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ১০৩ জন। অর্থাৎ এবার নারীর চেয়ে ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮৮ জন পুরুষ ভোটার বেশি।
নারী ভোটার এভাবে কমে যাওয়ার পেছনে আটটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন। সেগুলো মোকাবিলার চেষ্টাও করা হচ্ছে।
ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. নাসির উদ্দীন চৌধুরী জানান, বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে নারী ভোটার কম হওয়ার বিষয়ে আট কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অনীহা; হিন্দু অবিবাহিত মেয়েদের পিত্রালয়ে নিবন্ধন করতে অনীহা; অবিবাহিত, অনগ্রসর ও নিরক্ষর মেয়েদের ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে কম আগ্রহ; বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে ব্যর্থতা; রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র দূরবর্তী হওয়া; আবহাওয়া অনুকূল না থাকা; সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অজুহাতে ছবি তুলতে অনীহা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের অসচেতনতা অন্যতম।
নারী ভোটার বাড়াতে মাঠ কর্মকর্তাদের কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে সংস্থাটি। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভোটার তালিকায় নারীদের অন্তর্ভুক্তির হার যেন উল্লেখযোগ্যভাবে কম না হয়, সেই লক্ষ্যে হালনাগাদ কার্যক্রমের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (বিশেষ করে সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা), দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও গ্রাম পুলিশ বা চৌকিদার-দফাদারকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
এ ছাড়া হালনাগাদ কার্যক্রমে নারীদের নিবন্ধনের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিশেষ করে নারী জনপ্রতিনিধি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সদস্যসহ সাধারণ আসনের বিপরীতে নির্বাচিত মহিলা জনপ্রতিনিধি) সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
এরইমধ্যে বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা বা থানা, সিটি কর্পোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ এ কাজে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে তাদের প্রচারের কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আগামী ২০ জানুয়ারি থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করবে নির্বাচন কমিশন।
হালনাগাদে ভিনদেশিদের বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ : ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে কোনোভাবেই যেন রোহিঙ্গা বা ভিনদেশি কোনো নাগরিক অন্তর্ভুক্ত না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে ইসি। একইসঙ্গে আরও ১৫টি নির্দেশনা প্রতিপালনের জন্য বলেছে সংস্থাটি।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচিতে ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ ও সুপারভাইজার কর্তৃক যাচাই ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সম্পন্ন করা হবে। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি অথবা তার আগে যাদের জন্ম তাদের ও বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে যারা বাদ পড়েছেন তাদের ভোটার তালিকাভুক্তি ও মৃত ভোটারদের তালিকা হতে কর্তন করা হবে। এবং আবাসস্থল পরিবর্তনের কারণে স্থানান্তরের বিষয়েও কার্যক্রম গৃহীত হবে। এ কর্মসূচিতে হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন।
বিশেষ নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- ১। ১ জানুয়ারি ২০০৮ বা তার আগে যাদের জন্ম তাদের ও বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে যারা বাদ পড়েছেন তাদের তথ্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা;
২। তথ্য-সংগ্রহকালে কোনো ব্যক্তির তথ্য ফরম পূরণের আগে তিনি এরই আগে ভোটার হয়েছেন কিনা তা অবশ্যই নিশ্চিত করা; ৩। বাদ পড়া ভোটারদের ক্ষেত্রে বাদ পড়ার কারণ যাচাইপূর্বক নিশ্চিত হওয়া;
৪। কোনো ব্যক্তির নামের আগে বা পরে কোনো পেশা, খেতাব, পদবি, অর্জিত শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি সংযুক্ত না করা; ৫। ভোটারযোগ্য ব্যক্তির বাংলা নামের ইংরেজি বানান যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা; ৬। বাড়ি বাড়ি গমনের সময় ভোটারযোগ্য অনুপস্থিত ব্যক্তিদের তথ্যাদি অবশ্যই রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা; ৭। নিবন্ধন কেন্দ্রে আসার জন্য নিবন্ধন স্লিপ (ফরমণ্ড৫) ফরম পূরণের সাথে সাথে দেওয়া; ৮। সুপারভাইজার কর্তৃক তথ্যসংগ্রহকারীদের প্রতিদিনের তথ্য সংগ্রহের কাজ তদারকি ও নমুনা যাচাই করা; ৯। সুপারভাইজারগণ তথ্য সংগ্রহকারীর পূরণকৃত ফরমের কিছু অংশ দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি গমন করে শুদ্ধতা যাচাই করা এবং কোনো ভুল ধরা পড়লে তা শুদ্ধ করা; ১০। ভোটারযোগ্য নারীদের নিবন্ধনের বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করা অর্থাৎ কোনো ক্রমেই ভোটারযোগ্য কোনো নারী যেন বাদ না পড়েন তা তথ্যসংগ্রহকারী ও সুপারভাইজার কর্তৃক নিশ্চিত করা; ১১। নিবন্ধন ফরম পূরণকারীদের নিবন্ধন কেন্দ্রে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করা; ১২। বিশেষ এলাকার জন্য তথ্য ফরম পূরণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেয়া। বিশেষ তথ্য ফরম পূরণের সময় সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই করে অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ এলাকাসমূহের জন্য নিবন্ধন ফরমণ্ড২ এর সাথে বিশেষ তথ্য ফরমও পূরণ করা;
১৩। এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় ভোটার স্থানান্তরের আবেদন সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ ভোটার কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন অফিসারের নিকট দাখিল করা; ১৪। মৃত ভোটারের নাম কর্তনের জন্য ফরমণ্ড১২ এ তথ্য সংগ্রহকালে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। কোনোক্রমেই জীবিত ভোটারের নাম মৃত হিসেবে যেন তথ্য সংগ্রহ না করা হয়, সেজন্য সতর্ক থাকা; ১৫। সুপারভাইজার, তথ্যসংগ্রহকারী ও শনাক্তকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর সুস্পষ্টভাবে লেখা; এবং ১৬। কোনো ক্রমেই রোহিঙ্গা এবং ভিনদেশি ব্যক্তিদের তথ্য যেন সংগৃহীত না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা।