ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্নের আশঙ্কা

রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্নের আশঙ্কা

শীতে বাজারে পর্যাপ্ত সবজি সরবরাহ থাকায় সবজি কেনাকাটায় স্বস্তি ফিরলেও চিনি, তেল, ডিমের চড়া দামে অস্বস্তি রয়ে গেছে। এরমধ্যেই সামনের রমজানে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মানুষ। রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখনই বাড়তে শুরু করেছে। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও ভোজ্য তেল, ছোলা, খেজুর ও চিনির দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি তেলের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ২-৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের কেজি ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে এ দাম ছিল ৪০-৫০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে।

এ ছাড়া আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭৫ টাকা প্রতিকেজি। বর্তমানে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০-২১০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০-৬৫০ টাকায় ও সোনালি মুরগি ৩২০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে মুরগি। এছাড়া এক ডজন ডিম ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানা গেছে, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে কিছু ব্যাংক অসহযোগিতা করছে। যার কারণে দেশের তেল, ডাল, মসলা, চিনিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চললে রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এলসি খুলতে না পারায় সম্প্রতি সার্বিক তথ্য তুলে ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে চিঠি দেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এর আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও একটি চিঠি দেয়া হয়। সবশেষ গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে আরেকটি চিঠি দেয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে রমজান শুরু হবে। ডলারের দাম ঠিক থাকলে রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা অব্যাহত থাকলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে থেকেই চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা, খেজুরসহ ১১টি পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলায় মার্জিন কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে।

গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ছয় লাখ ৬৪ হাজার ১৭৬ মেট্রিক টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার পাঁচ টন, পরিশোধিত এক লাখ এক হাজার ১৭১ টন। একই সময়ে গত অর্থবছর আট লাখ ৬৪ হাজার ৮০ টন চিনি আমদানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনি সাত লাখ ৯৯ হাজার ৫০৮ টন, পরিশোধিত ৬৪ হাজার ৫৭১ টন। এছাড়া গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আট লাখ ৮৯ হাজার ২৮৪ টন চিনি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। গতবার এর পরিমাণ ছিল নয় লাখ ১৬ হাজার ৪২৫ টন। আমদানির পাইপলাইনে আছে তিন লাখ ৭৬৮ টন চিনি। দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন। আমদানি হয় ২১ থেকে ২৩ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা তিন লাখ টন।

ট্যারিফ কমিশন বলছে, বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে আড়াই লাখ টন তেল দেশে উৎপাদিত হয়। ২২ থেকে ২৩ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা তিন লাখ টন। সেই হিসেবে রমজানে তেলের কোনো সংকট থাকার কথা নয়।

দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার ঢাকার মৌলভীবাজারের বড় ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, কিছুদিন আগেই তেলের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এরপর পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আগে থেকেই কিছুটা কমতির দিকে। আশা করছি, কোম্পানিগুলো সরবরাহ ঠিক রাখলে তেলের দামে আর সমস্যা হবে না।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯৮০ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৭ হাজার ৪৪৬ টন ছোলা। এবার একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯১৯ টন। গতবার খোলা হয়েছিল এক লাখ ১৮ হাজার ৪৫৪ টন। এবার আমদানির পাইপলাইনে আছে এক লাখ ৫৪ হাজার ১৯১ টন ছোলা। গতবার পাইপলাইনে ছিল ৮৮ হাজার ৩০৯ টন। সব মিলিয়ে এবারের রমজানে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ছোলা থাকবে।

বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, চাহিদা কম বলে ছোলা-ডালের দাম এখনই নিম্নমুখী। বাজার স্থিতিশীল থাকবে রমজানেও।

নিত্যপণ্যের আমদানি ঠিক থাকলেও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে কারসাজির কারণে প্রায় প্রতি রমজানে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি পর্যায়ে সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, রমজানে ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশলে বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে থাকেন। এবারও নিশ্চয়ই তাদের এই অপচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে এটা থেকে যে ভোক্তা মুক্তি পাবে, তেমন কোনো কার্যক্রম দেখছি না। বাজার তদারকিতে এখনও দুর্বলতা রয়ে গেছে। আবার গত ৫ আগস্টের পরে দেশের অনেক নিত্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাত গুটিয়ে আছে। সে ঘাটতি পূরণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্য যারা বাজারে আছেন, তাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা সেভাবে হচ্ছে না। সে কারণে কারসাজি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার যে অস্থিতিশীল হবে না- সেটা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, আমরা যদিও ভাবছি, বাজার ঠিক থাকবে, তারপরেও ডলারের দাম কিন্তু বড় ভূমিকা রাখবে। ডলার যদি ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে থাকে তবে দাম ঠিক থাকবে। কিন্তু হুট করে বাড়লে সেটা নিশ্চয়ই বাজার অস্থিতিশীল করবে। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবেই।

টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. শফিউল আতহার তাসলিম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারেও এই মুহূর্তে কোনো পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা নেই। তবে আমরা ঠিকমতো ডলার পাবো কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত। ডলারের দাম ঠিক থাকলে পণ্যের দামে হেরফের হবে না।

তবে আসন্ন রমজান মাসে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী প্রায় এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারের কাছে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির লক্ষ্যে ভোজ্য তেল, চিনি ও ডাল কিনবে সরকার। এরই মধ্যে ১০ হাজার টন মসুর ডাল, ৫ কোটি ৫০ লাখ লিটার ভোজ্য তেল এবং ১৫ হাজার টন চিনি কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দরপত্রের মাধ্যমে ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনির ক্রয়মূল্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির আগামী বৈঠকে এই মসুর ডাল, ভোজ্য তেল ও চিনি কেনার প্রস্তাব উপস্থান করা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিলে মসুর ডাল, ভোজ্য তেল ও চিনি কেনার পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

বাজার করতে আসা গুলশানের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মী বলেন, যখন তখন ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে আমাদের সব টাকা নিচ্ছে। খরচ কুলানো কষ্ট। তবুও কোনোরকম চলে যাচ্ছে।

বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২-৭ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৫-১৭২ টাকায়। গত সপ্তাহে এ দাম ছিল ১৬৩-১৬৫ টাকা। আর বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৭৪-১৭৫ টাকা। গত সপ্তাহে ছিল ১৭৩-১৭৫ টাকা। যদিও খুচরা দোকানগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কিছুটা কম রয়েছে। মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পাবদা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, তেলাপিয়া ২০০-২২০, চাষের শিং ৫০০ থেকে ৫৫০, আকারভেদে চাষের পাঙাশ ১৮০-২২০, ১ কেজি ওজনের রুই ২৫০-২৮০, বড় রুই ৩৫০-৪৫০ ও চাষের কৈ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকায়। আর আকারভেদে প্রতি কেজি কাতলা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, কোরাল ৭০০ থেকে ৭৫০, ট্যাংরা ৫৫০ থেকে ৭০০ ও চিতল ৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। পণ্যের দাম কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে; তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবছর রমজান সামনে রেখে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে সরবরাহে সংকট না থাকলেও কিছু অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীর একটি অংশ রমজানকে কেন্দ্র করে বাড়তি মুনাফা পেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রমজান শুরুর আগে ছোলা, খেজুর ও সয়াবিন তেলের দাম এরইমধ্যে বেড়ে গেছে। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এরইমধ্যে হিমশিম খাওয়া নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়ছে।

রমজান সামনে রেখে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি না থাকলেও ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ তৈরি হয়। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাজারে চাহিদা ও জোগানের ওপর দ্রব্যমূল্য নির্ভর করে। কিন্তু সেই সংজ্ঞা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে না। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলছে। রমজানের আগে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎপাদন এবং পণ্য সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত