ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশকিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী কারামুক্তি পেয়েছেন। এসব সন্ত্রাসী কারমুক্তি পেয়েই পুরোনো সা¤্রাজ্য ফিরে পেতে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ অপরাধের পুরোনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দিচ্ছেন। চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সেজন্য অপরাধ জগতে জড়িয়েপড়া এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন করবে পুলিশ।
জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় প্রতিনিয়ত অপরাধের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকার ‘দখল’ নিতে সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী হোক বা যে-ই হোক, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। সেজন্য সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিলের কথা ভাবছে পুলিশ।
সূত্র বলছে, রাজধানীর মতিঝিল, মগবাজার, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় এসব সন্ত্রাসীর তৎপরতা বেশি দেখা গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বের হয়েই ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসা, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন, ফুটপাত, বাজার, ঝুট ব্যবসা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা তোলা ও আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। যারা জামিনে বের হয়েছেন, তাদের ওপর নজরদারি রয়েছে। আর আত্মগোপনে থেকে যারা প্রকাশ্যে এসেছেন এবং অপরাধে জড়াচ্ছেন অথবা ভীতিকর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন, তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসবে পুলিশ।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের পটপরিবর্তনের সময়কালে কারাগার থেকে ৪৩ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়েছে বলে জানান কারা মহাপরিদর্শক ব্রি. জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কারা অধিদপ্তরের বকশিবাজার কনফারেন্স রুমে এক মতবিনিময় সভায় তিনি আরো বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আগে এবং পরে কারাগারে বন্দি ছিল ১৫ হাজার; বর্তমানে সবাই কারামুক্ত।
দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন। কারাগার থেকে বেরিয়েই তারা নানা ধরনের অপরাধ ও অপকর্মসহ আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে বলে তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
চাঁদা না পেয়ে দখলের চেষ্টা করা হচ্ছিল মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার। সেটাও সম্ভব হয়নি ছাত্র-জনতা ও ব্যবসায়ীদের কারণে। ক্ষোভ থেকেই গত ১০ জানুয়ারি রাতে টার্গেট করে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে কোপানো হয় দুই ব্যবসায়ীকে। তবে দুই ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম, যারা একসময় অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। জানা গেছে, হামলার নেপথ্যে সন্ত্রাসীর আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির দ্বন্দ্ব। যারা জেলে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন অপরাধ জগত। গত শুক্রবার রাতে ব্যস্ত সড়কে ১২-১৫ জনের দুর্বৃত্ত দলের এক থেকে দেড় মিনিটের অতর্কিত হামলার শিকার হন এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেসামুল হক। এ ঘটনার ১০-১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে চাপাতি দিয়ে কোপানোর নৃশংসতা ফুটে উঠেছে। পরে তাদের উদ্ধার করে পাশের পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এ ঘটনায় হাত ও পায়ে মারাত্মক জখম হয়।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছে। তাদের সংস্পর্শে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে এসেছে। তারা অপরাধের পুরোনো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেয়ার পাশাপাশি চাঁদা চেয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে।
‘দীর্ঘ সময় জেলে থাকার পরও তাদের মধ্যে কোনো সংশোধন নেই, এটি খুবই দুঃখজনক। বয়স হলেও জেল থেকে বের হয়ে সেই আগের মতো চাঁদাবাজি, দলাদলি শুরু করেছে তারা।’ এসময় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছি। জেল থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের অপকর্মে জড়াচ্ছে। আমরা তাদের জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করবো।
তিনি বলেন, ক’দিন আগেও দেখলাম ‘বেনজীরের ক্যাশিয়ার’ খ্যাত জসিম জামিন পেয়েছেন। সুব্রত, পিচ্চি হেলাল ও ইমনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত খবর বেরুচ্ছে। আধিপত্য নিয়ে তারা বিরোধে জড়াচ্ছে। তাদের নানা অপকর্মে জড়ানোর তথ্যও পাচ্ছি। রেকর্ড হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। তাদের পেলেই আমরা ধরে ফেলবো। কাউকে ছাড় দেবো না। আপাতত আমরা তাদের জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করবো।
খুনের ঘটনাকে যদি ছিনতাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয় তাহলে তা মানুষের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হবে- এ কথা উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমাদের সবার দায়িত্ব আছে। আমরা চাই বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদটা প্রকাশ পাক। খুনের সব ঘটনা কিন্তু ছিনতাইকারীদের হাতে হচ্ছে না। অনেক কারণ আছে খুনের। তার মধ্যে একটি কারণ হয়তো ছিনতাই। গুণ্ডাপাণ্ডা বা অপরাধীরা নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে নিহত হওয়ার ঘটনাও কাম্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, যারা নিজেরা মারামারি করছে সেখানে প্রোঅ্যাকটিভ পুলিশিং দরকার। আমরা এ ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করতে পারি না। এর কারণে সমাজে নিরাপত্তাহীনতাবোধ তৈরি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারমুক্ত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই এক থেকে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন।