ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বহু যোগ্য মানুষকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেছেন। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেই বিতর্ক এড়াতে তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। গত বছর বিতর্কের জেরে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার তার পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন।
বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং পুরস্কার-তালিকাভুক্ত কারো কারো সম্পর্কে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় পূর্বঘোষিত ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’-এর পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন সম্পর্কে আলোচনা হয়। উত্থাপিত অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বঘোষিত তালিকা গত শনিবার স্থগিত করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার পর তালিকাটি আবার প্রকাশ করা হবে।
গত বৃহস্পতিবার একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনে মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের তালিকা ঘোষণা করা হয়। তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরা হলেন কবিতায় মাসুদ খান, কথাসাহিত্যে সেলিম মোরশেদ, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ, অনুবাদে জিএইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান ও ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ। পুরস্কারের তালিকা ঘোষণার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হয়। তালিকায় নাম থাকা কয়েকজনের বিষয়ে আপত্তি ওঠে। কোনো নারীর নাম তালিকায় না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন কেউ কেউ।
অর্জয়িতা রিয়া নামে একজন লেখেন, ‘অনেকে বলেন যোগ্য লেখকদের সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়। এইটা ভুল কথা। সাহিত্যে পুরস্কার কেউ যোগ্যতার ভিত্তিতে দেয় না, দেয় গুরুত্ব বিবেচনায়। সেটা নোবেল বলেন, আর বাংলা একাডেমি বলেন। তবে দেখা যাচ্ছে গুরুত্ব বিবেচনার ক্ষেত্রে বারবার বাংলা একাডেমি একটা নির্দিষ্ট জেন্ডারকে বাদ দিচ্ছে, নারীদের।’
‘বাংলা একাডেমি কি আওয়ামী লীগারদের পুনর্বাসন-পুরস্কার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে?’ এ প্রশ্ন তুলে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মাহবুব মোর্শেদ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লেখেন, ‘শেখ মুজিবকে নিয়ে বইয়ের পর বই লেখা ফারুক নওয়াজ ও মোহাম্মদ হাননান কীভাবে পুরস্কার পেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। এ দুজন নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগার।’
তালিকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের নাম থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। মাহবুব মোর্শেদ লেখেন, ‘বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি একই মন্ত্রণালয়ের অধীন দুই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান দুটি নানা সূত্রে পরস্পর সম্পর্কিত। এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে পদে থাকা অবস্থায় পুরস্কার দেয়া যায়?’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শাতিল সিরাজ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘এরপর কারো পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা বা নিয়োগ পাওয়ার খবর শুনে মিষ্টি খাওয়া বড্ড ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে!।’
বাংলা একাডেমির আমূল সংস্কার, ‘ফ্যাসিবাদী’দের অপসারণ এবং পুরস্কার ‘কেলেঙ্কারি’তে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে একাডেমির সামনে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ‘বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজ’ ও ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ নামের দুটি প্লাটফর্ম। গতকাল রোববার দুপুরে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার পর তাদের একটি প্রতিনিধিদল বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। তিন কর্মদিবসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার পর তালিকাটি পুনঃপ্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি।
লেখক আবিদ আজম বলেন, স্বৈরাচারের দোসরদের পুরস্কার স্থগিত নয়, বাতিল করতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারের সময় বাংলা একাডেমিতে অনেক অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের বাদ দিতে হবে। পুরস্কারের জুরিবোর্ডে যারা ছিলেন, তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে।
মামুন সারওয়ার বলেন, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ড. শহীদুল্লাহকে নিয়েও তারা কোনো কাজ করেনি। এই বাংলা একাডেমি একটা পরিবার নিয়েই ব্যস্ত ছিল, তা হলো শেখ হাসিনার পরিবার। বাংলা একাডেমিতে আমূল সংস্কার করতে হবে। এবিএম সোহেল রশিদ বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বাংলা একাডেমি থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিতাড়িত করতে হবে। অন্যদের মধ্যে কবি মঈন মুনতাসীর, কবি সাম্য শাহ, মাহবুব হাসান, শাকিল মাহমুদ, পলিয়ার ওয়াহিদসহ অনেকে সেখানে বক্তব্য দেন।
এদিকে গতকাল রোববার সচিবালয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, বাংলা একাডেমির পুরস্কার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গোলমাল ছিল। এখন পুরো বাংলা একাডেমিকে ঢেলে সাজানো হবে। বাংলা একাডেমিকে বিশেষ মত ও গ্রুপের লোকের আখড়া বানানো হয়েছিল, নতুন চিন্তা প্রবেশের জায়গায় রাখা হয়নি।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারের তালিকা প্রকাশের পর অভিযোগ ওঠায় তা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আজম। তালিকায় নাম থাকা কারো বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জনবিরোধী রাজনীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে পুরস্কার বাতিল করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষিত হলেও আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানা ধরনের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া দেখেছি। আমরা পুরো ব্যাপারটা আমলে এনেছি। আমাদের ঘোষিত পুরস্কারের তালিকাটি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এই তালিকাটি রিভিউ করবো। প্রধানত গণহত্যা ও জনবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যদি কারো সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাই, যে অভিযোগ আমাদের সামনে এসেছে, আমরা সেটা একটু খতিয়ে দেখছি। অনুসন্ধান করছি। যদি এ ধরনের সরাসরি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা সেটা বাতিল করবো। এর পরিবর্তে সেখানে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের যে কমিটিগুলো কাজ করছে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করছি সেটা আমরা তিন কর্মদিবসের মধ্যেই করতে পারবো।
মহাপরিচালক বলেন, বাংলা একাডেমির সার্বিক পরিস্থিতি এবং সার্বিক পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে নানা পক্ষের কিছু অসন্তোষ আছে। অনেকদিন আগে আইন হয়েছে, বিধি হয়েছে, প্রবিধানমালা হয়েছে। সেগুলো আমাদের পুনঃনিরীক্ষার প্রয়োজন অনেকদিন ধরেই বোধ করছিলাম।
মোহাম্মদ আজম বলেন, ব্যস্ততার জন্য আমরা ঠিক করেছিলাম এগুলো মার্চ থেকে শুরু করবো। সেটা এখন আমরা একটু এগিয়ে এনে হয়তো খুব শিগগিরই একটা সংস্কার কমিটি গঠন করে, যেখানে মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক ও সৃজনশীল কাজের যুক্ত বিভিন্ন পক্ষ যারা চিন্তা-ভাবনা করছেন বা এ বিষয়ে আগ্রহী তাদের একটা অংশগ্রহণ থাকবে। কমিটিটা অন্তর্ভুক্তিমূলক করে পুরো ব্যাপারটা রিভিউ করতে চাইবো। কী কী ভাবে বাংলা একাডেমিকে নতুন চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়, আরো বেশি কর্মক্ষম করা যায়। শিগগিরই আমরা এ ধরনের একটি কমিটি করবো। আমরা কর্মপরিকল্পনা করছি, কাজ শুরু করছি, শিগগিরই আপনাদের জানাতে পারবো।