সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর অনুমতি দিলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের চাহিদা মতো বোতলজাত তেল মিলছে না। আসন্ন রমজানে আরেক দফা ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে সিন্ডিকেটরা। সেজন্য খুঁচরা দোকান, সুপার শপের পাশাপাশি অনলাইন সর্বত্র ভোজ্যতেলের সংকট।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৬ মে বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের মূল্য রেকর্ড করেছিল। এতে ভোক্তা পর্যায়ে ক্ষোভ আর অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই অসন্তোষ আর কাজে লাগেনি। ২০২৪ সালের ৯ ডিসেম্বরে এসেও সয়াবিল তেলের দাম বাড়াল। ওইদিন সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের নতুন দাম ঘোষণা করেন।
এতে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বাড়ছে। ফলে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর অনুমতি দিলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের চাহিদামতো বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না।
এদিকে ২১ নভেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ সম্মেলনকক্ষে সার্বিক বাজার পরিস্থিতি, টিসিবির পণ্য বিতরণের সার্বিক কার্যক্রম ও দ্রব্যমূল্য বিষয়ে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, আমরা ব্যবসায় বেশিসংখ্যক মানুষের সংযোগ বাড়াতে চাই। এর মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। গুটিকয় ব্যবসায়ীর কাছে বাজার জিম্মি থাকবে না। চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে। সরবরাহে কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে দেয়া হবে না।’ খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত বোতলজাত সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না। অন্যদিকে সুপারস্টোরগুলোও ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। দোকান ও সুপারশপে বোতলজাত সয়াবিন তেল না পেয়ে অনেকে বিকল্প হিসেবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চেষ্টা করেন। তবে, সেখানেও প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে।
ঢাকার ডেমরা এলাকার বাসিন্দা তৌহিদ হোসেন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে সয়াবিন তেল কেনার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন, এক লিটার বোতলের সয়াবিন তেল পেয়েছি। চেষ্টা করেও সেখানে দুই বা পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া যায়নি।
তিনি আরো বলেন, সূর্যমুখী ও সরিষার মতো অন্য তেল পাওয়া গেলেও বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। প্রায় এক মাস ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকার খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার পর ডিলাররা বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ শুরু করলেও চাহিদার তুলনায় তা এখনো কম।
ব্যবসায়ীদের দাবি, গত ৯ ডিসেম্বর সয়াবিনের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। খোলা সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয় লিটারপ্রতি ১৫৭ এবং বোতলজাত ১৭৫ টাকা। তবু সরবরাহ সংকট কাটেনি। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ভোজ্য তেলের দাম সহনীয় রাখতে নতুন বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এরপরও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট কাটেনি। এই অবস্থার মধ্যে গত ৬ জানুয়ারি ভোজ্য তেলের দাম বাড়াতে ট্যারিফ কমিশনে নতুন প্রস্তাব পাঠায় মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
ক্রেতারা বলছেন, বাজারে সংকটের অপর নাম ভোজ্যতেল। সংকট যেন কাটছে না কিছুতেই। সরকার থেকে দাম বাড়ালেও সংকট থেকে মুক্তি মিলছে না। বিশেষ করে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পেতে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে।
ঢাকার মাতুয়াইল এলাকার দোকানদাররা বলছেন, কোম্পানি প্রতিনিধিদের বারবার অর্ডার দিলেও চাহিদা অনুযায়ী তেল দিচ্ছে না। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম কিছুটা কমেছে। তারপরও মিল থেকে তেলের সরবরাহ এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
যাত্রাবাড়ী বাজারের দোকানি তানভির বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ডিলাররা সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। অর্ডার দিয়েও তেল পাচ্ছি না। অনেকেই তেল চাচ্ছে দিতে পারছি না। এক দফা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরও সরবরাহ স্বাভাবিক নয়। রমজানকে ঘিরে আরেক দফা দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে বড় ব্যবসায়ীরা। বাধ্য হয়ে বর্তমানে খোলা তেল ১৮৫-১৯০ টাকায় বিক্রি করছি।
সয়াবিন ও পামতেলের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে দর বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র রমজান মাসে পণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে অব্যাহতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সয়াবিন ও পাম তেলের অব্যাহতির মেয়াদ আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ভোজ্যতেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ মূসক ব্যতীত অন্য শুল্ক-করাদি প্রত্যাহার করা হয়। গত অক্টোবরে এমন আদেশ জারি করেছিল এনবিআর। আর ১৬ ডিসেম্বর ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার তেল আমদানিতে আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার পাশাপাশি মূসক বা ভ্যাট হ্রাস করে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও ভোজ্য তেলের বাজার স্বাভাবিক হয়নি বলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই দাবি করছেন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে। তাই সরকারকে চাপে ফেলে কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। তবে এখন যে তেল তারা মিল থেকে সরবরাহ করছে, তা আগের কম দামে কেনা।