গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো আলোচনায় এসেছে নির্বাচনকলীন সরকার ও রাজনৈতিক সংলাপ। এমন অবস্থায় দেশের রাজনীতির মাঠ আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল ভোটের আগে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন বলে দাবি তুলেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে, তফসিলের ঘোষণার আগ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন থাকবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে।
সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে তৈরি হয় উত্তেজনা, চলে বাহাস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। হয় ডিসেম্বর ২০২৫ অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে এটিও বলা হচ্ছে যে, নির্বাচনের সময়সূচি নির্ভর করছে জনগণ কতটুকু সংস্কার চায়, তার ওপর। এরইমধ্যে ইসি জানিয়েছে চলতি বছর ভোট করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আগামী বছর ভোট হতে পারে।
জানা যায়, এরইমধ্যে নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। বর্তমান সরকার নির্বাচনের আগে সংস্কার করতে চায়। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনও চায়। বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সময় যতই যাচ্ছে নির্বাচনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা আরো বেশি তীব্র হচ্ছে। এরইমধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচন করতে পারবে না।
তিনি বলেন, নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসতে পারে। কেননা, এখানে আমরা জিনিসটা লক্ষ্য করছি যে, আপনার ছাত্ররা একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার কথা চিন্তা করছেন। সেখানে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি এ সরকারে থাকে, তাহলে তো নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। ওইটা হচ্ছে, সম্ভাব্য কথা। কিন্তু যদি তারা মনে করে যে, সরকারে থেকেই তারা নির্বাচন করবেন, তাহলে তো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।
বর্তমান সরকার নির্বাচনে আগে সংস্কার করতে চায়। তবে, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনও চায়। বিএনপি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন কন্ডাক্ট (পরিচালনা) করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের এমন মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। নিজ ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এ সমন্বয়ক বলেন, বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে সামনে আরেকটা এক-এগারো সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার আলামত রয়েছে। এই এক-এগারোর বন্দোবস্ত থেকেই আওয়ামী ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছিল।
বিএনপি মহাসচিব ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কের পাল্টাপাল্টি এমন মন্তব্য রাজনৈতিক মাঠে আবারো নিরপেক্ষ অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সামনে এসেছে। শুধু বিএনপি নয়, এরই মধ্যে আওয়ামী লীগও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছে। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে গত শুক্রবার দেয়া এক পোস্টে মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ‘অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকার’। এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে না এবং পরবর্তী নির্বাচন একটি নতুন (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে হতে হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ তো মাঠে নেই। দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়নি। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে অংশ নেবে, নিলে প্রক্রিয়াটি কী হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদের বলেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তারা (বর্তমান সরকার) সারা দেশে জনবিরোধী কার্যকলাপ শুরু করেছে। ভ্যাটের নামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সারা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। সর্বোপরি তারা (বর্তমান সরকার) দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, খুব অল্পদিনের মধ্যে জনগণই তাদের বিদায় করবে। তাদের বিদায়ের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাজনীতিবিদরা কোন বিষয়ে কথা বলবেন, কোনটাকে সমর্থন করবেন আর কোনটাকে করবেন না এটা কি উপদেষ্টারা শেখাবেন?’ বিএনপির সিনিয়র এ নেতা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কেজিপ্রতি দুই থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের এমন উদাসীনতার কি সমালোচনা করা যাবে না? সরকারের প্রশাসন যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে সেজন্য কি সমালোচনা করা যাবে না? তাহলে কীসের ভয় দেখান যে ১/১১-এর পুনরাবৃত্তি হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি আবারো ১/১১ (ওয়ান-ইলেভেন) আনার পাঁয়তারা করছে। ১/১১-এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার বিএনপির চেয়ে কেউ বেশি হয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ওই সরকারের নির্যাতন থেকে দলের কোনো নেতাকর্মীই রেহাই পাননি। এভাবে কথা বললে দেশের গণতন্ত্রের চেহারা কেউ দেখতে পারবেন না।
মির্জা আব্বাস বলেন, একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’- তারা তো এখন বিএনপির বিরুদ্ধেই কথা বলছে। শিশুদের যখন নতুন দাঁত ওঠে তখন উল্টাপাল্টা কথা বলে। এখন কেউ কেউ এমনভাবে কথা বলছেন যে, বিএনপি আওয়ামী লীগের দোসর, বিএনপি ভারতের দোসর। যারা এগুলো বলছেন, তারা যেন নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের কোনো যোগাযোগের ঘাটতি নেই। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে যোগাযোগ কম, তবে বাস্তবে এমন কিছু নেই। আমরা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী যে, অন্তর্বর্তী সরকারই নির্বাচনে নিরপেক্ষতার ভূমিকা পালন করবে।
বিএনপি নেতাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল আরো বলেন, বিগত কয়েকদিন ধরে নির্বাচনি ইস্যুতে কিছু সমালোচনা হচ্ছে, তবে উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে কোনো পরিবর্তনের আলোচনা হয়নি। ভবিষ্যতে এমন কিছু হতে পারে, তবে এ মুহূর্তে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজোয়ানা হাসান জানান, বিএনপির বক্তব্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের সতর্কবার্তা। এটি তাদের দেয়ার অধিকার রয়েছে। তবে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে তাকে অবশ্যই সরকার থেকে সরে গিয়ে তা করতে হবে।