ঢাকা শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আশায় বুক বেঁধেছেন রোহিঙ্গারা

আজ লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করবেন ইউনূস ও গুতেরেস
আশায় বুক বেঁধেছেন রোহিঙ্গারা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আজ শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসছেন। এদিন তারা মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত এক লাখ নাগরিকের সাথে ইফতার করবেন। এর আগে সকালে ১১টায় ক্যাম্পে পৌঁছে শুনবেন রোহিঙ্গাদের দাবি-দাওয়ার কথা। অংশ নেবেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পে জাতিসংঘ মহাসচিবের এটি দ্বিতীয় সফর হলেও আশ্রয়শিবিরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এটি প্রথম সফর।

ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, লাখো রোহিঙ্গার সাথে জাতিসংঘ মহাসচিবের ইফতার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যেখানে রোহিঙ্গা নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবেন। এ নিয়ে রোহিঙ্গাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এরই মধ্যে প্রস্তুত ইফতার আয়োজনের ভেন্যু, মেরামত করা হয়েছে রাস্তা-ঘাট। পরিদর্শনের সম্ভাব্য স্থানগুলো সাজানো হয়েছে নতুন করে।

এ ব্যাপারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আশ্রয়শিবিরে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘের মহাসচিবের সফর ঐতিহাসিক। এই সফরে আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আছে এবং তারা স্বদেশে ফিরবে এমন বার্তা দিবে।’

দিনব্যাপী যত কর্মসূচি : প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রাথমিক সফরসূচি উল্লেখ করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, শুক্রবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকা থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। এ সময় ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে স্বাগত জানাবেন।

এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে পৌঁছাবেন। পরিদর্শনের সময় একটি ওয়াচ টাওয়ারে উঠে আশ্রয়শিবিরের বর্তমান চিত্র পর্যবেক্ষণ করবেন। এরপর সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হবে। এ ছাড়া জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও সেবা কার্যক্রমের হালচাল তুলে ধরবেন। বিশেষ করে, খাদ্য সহায়তা কমে আসা এবং খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার বিষয়টি বলা হবে। পরিদর্শনকালে জাতিসংঘের মহাসচিব বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) একটি লার্নিং সেন্টার, ইউএনএইচসিআর এবং ডব্লিউএফপির সেবা ও ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাবেন। পাশাপাশি পৃথক তিনটি বৈঠকে রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা, তরুণ ও নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

এরপর জাতিসংঘ মহাসচিব সন্ধ্যায় ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশন হেলিপ্যাড এলাকায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জন্য প্রধান উদেষ্টা আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরের আশ্রয় শিবিরে কার্যক্রমগুলোর তত্ত্বাবধান করছেন সেনাবাহিনী। তাদের সঙ্গে রয়েছে পুলিশ, এপিবিএন, জেলা প্রশাসন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। তাদের নিরাপত্তায় থাকছে কয়েক স্তরে নিরাপত্তা বলয়।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আশ্রয়শিবিরে কার্যক্রমগুলো সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। পুলিশ কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ক্যাম্প পর্যন্ত থাকছে কয়েক স্তরের বলয়। মূলত, এসএসএফ কক্সবাজার চলে এসেছেন, তা?রা সব বিষয় সমন্বয় করছেন। আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করছি। প্রধান উপদেষ্টার কক্সবাজার শহর কেন্দ্রিক কিছু ভেন্যু রয়েছে, এসব ভেন্যুতেও কয়েক স্তরের নিরাপত্তার বলয় থাকছে।’

নতুন আশায় রোহিঙ্গারা : এদিকে দুইজনের এই সফরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আশার আলো সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মহল তাদের সঙ্গে আছে। নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরতে রোহিঙ্গারা আশায় বুক বেঁধেছে। এ জন্য টেকসই প্রত্যাবাসন, নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানাবেন। এছাড়া বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সহায়তা কমিয়ে নেয়ার বিষয়টি সমাধান করবেন।

জানতে চাইলে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আশ্রয়শিবিরে আসার খবরে সাধারণ রোহিঙ্গারা খুবই উৎফুল্ল। বৈঠকে আমরা মহাসচিবের কাছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আরাকান রাজ্যে সেফ জোন প্রতিষ্ঠার দাবি জানাব। খাদ্যসহায়তায় কাটছাঁট করার ফলে শরণার্থীদের জীবনে যে নেতাবাচক প্রভাব পড়ছে, তাও তুলে ধরা হবে।’

উখিয়ার ৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল জব্বার বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব ক্যাম্পে আসবে শুনে খুবই খুশি লাগছে। তাকে দুঃখ-কষ্টের কথা শোনাতে পারব। এছাড়া ডব্লিউএফপি আমাদের খাদ্য কমিয়ে দিচ্ছে এটা বলতে পারব।’ বর্ধিত ৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা কলিম উল্লাহ বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ মহাসচিবকে বুঝাব, দ্রুত সময়ে আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে যেন রাখাইনে ফেরত পাঠায়।’ লম্বাশিয়া ১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মো. তৈয়ব বলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা ফিরে যেতে চাই। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি সবারই দেশে ধন-সম্পত্তি রয়েছে। এখন জাতিসংঘ রাখাইনে নিরাপত্তা দিলে এক্ষুনি স্বদেশে চলে যেতে রাজি।’ উখিয়ার ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল মোনাফ বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান ড. ইউনূস সাহেব আমাদের দেখতে আসবে এটা শুনেই খুবই খুশি লাগছে। জাতিসংঘের প্রধান আসবেন সেটাও আমাদের জন্য অত্যন্ত খুশির খবর।’ একই ক্যাম্পের বাসিন্দা রোহিঙ্গা যুবক নছর উল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রথম ড. ইউনূসকে দেখতে পাব। আমার খুব ইচ্ছা আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা, ক্যাম্পে আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথা তাকে জানাব।’

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। যার মধ্যে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন। পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪টি। দীর্ঘ ৮ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো গত কয়েক মাসে নতুন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২ জুলাই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সে সময় তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত