ঢাকা শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘পুরো বাংলাদেশ ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত’

কাঁদিয়ে চলে গেল আছিয়া

* স্বজনদের আহাজারি, চাইলেন ধর্ষকের ফাঁসি * প্রধান উপদেষ্টার শোক, আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ * বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সংগঠনের শোক * মাগুরায় নিজ গ্রামের বাড়িতে নোমানী ময়দানে জানাজা
কাঁদিয়ে চলে গেল আছিয়া

ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাগুরায় নির্যাতিত সেই শিশুটি মারা গেছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শিশুটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক কর্নেল নাজমুল হামিদ মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) সকাল বেলা শিশুটির দুই দফায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। প্রথম দফায় সিপিআর দেয়ার পর তার হৃৎস্পন্দন ফিরে আসে। কিন্তু বেলা ১২টার দিকে তার আবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। সিপিআর দেয়ার পরও তার হৃৎস্পন্দন আর ফিরে আসেনি। বেলা ১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শিশুটি গত ৮ মার্চ সন্ধ্যায় গুরুতর অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়। চিকিৎসার পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটির শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। তার অবস্থা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন এবং চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এর আগে, গত ১২ মার্চ, সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়, শিশুটির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সকাল সোয়া ১১টায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, শিশুটির ব্রেন ফাংশন বন্ধ হয়ে গেছে এবং সে কোমায় (গিসিএস লেভেল ৩) ছিল। তার রক্তচাপ এবং অক্সিজেন লেভেলও অনেক কমে গিয়েছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও শিশুটি দু’বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়, সিপিআর দেয়ার পর কিছু সময়ের জন্য তার অবস্থা স্থিতিশীল হলেও পরে আবারও হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।

সেনাবাহিনী জানায়, শিশুটির রক্তে লবণের ভারসাম্যহীনতার কারণে ডায়ালাইসিসও করা হচ্ছিল। তাছাড়া, তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি পর্ষদ গঠন করা হয়েছিল।

শিশুটির জন্য সেনাবাহিনী দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছিল, যেখানে বলা হয়, ‘শিশুটির অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। তার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তার জীবন রক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। অবশেষে, বেলা ১টার দিকে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়, যা পুরো দেশবাসীকে শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন করে। ধর্ষকের করা ন্যক্কারজনক ক্ষত নিয়ে কয়েক দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা গেছে শিশু আছিয়া। শিশুটির মৃত্যুর খবর শুনে বাকরুদ্ধ মা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করছেন।

শিশুটির মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে গণমাধ্যমে বলেন, ‘আছিয়ার জানাজা গ্রামেই হবে। আমার মণিকে বেলেট দিয়ে ক্যামবা কাটিছে রে। আমার মণির পুরো গলায় ঘা হইয়্যা গেছে রে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সিএমএইচ থেকে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি মাগুরা নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মেয়েকে দাফন করা হবে। আর আমার মেয়ের সঙ্গে যারা খারাপ কাজ করেছে তাদের ফাঁসি চাই।

এদিকে শিশুটির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

এদিকে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আর আগামী সাত দিনের মধ্যে মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার শুরু হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা এ কথা জানান আইন উপদেষ্টা।

ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাগুরায় নির্যাতিত শিশুটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একইসঙ্গে এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। গতকাল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেয়েটির মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে মির্জা ফখরুল এই দাবি জানান। মির্জা ফখরুল বলেন, মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিল। আর কতটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি তার বিদেহী রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি তারা এই শোক কাটিয়ে উঠুন। পাশাপাশি এই নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

আছিয়ার বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করে এবং ধর্ষকের বিচার দাবি করে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে বলেন, শিশু আছিয়া ইতিহাসের করুণ সাক্ষী হয়ে দুনিয়া ছেড়ে সারা বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চলে গেল। আল্লাহ তায়ালা তাকে একান্ত প্রিয় হিসেবে কবুল করুন। জান্নাতে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা মেহেরবানি করে দান করুন।

আছিয়াকে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার দাবি করে জামায়াত আমির বলেন, মানুষ নামের যে পশুরা তাদের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে মাসুম শিশুটির জীবনের আলো নিভিয়ে দিল, এ পশুদের কঠিনতম ও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। সর্বোচ্চ ৯০ দিনের ভেতরে (৯০ কর্ম দিবস নয়) এদের শাস্তি কার্যকর করতে হবে।

পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিধ্বস্ত পরিবারকে কোন ভাষায় সান্ত¡না দেব সে ভাষাটিই হারিয়ে ফেলেছি। মহান রবের দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন তার পিতা-মাতাসহ আপনজনদের-নির্বিশেষে, বিবেকবান দেশবাসীকে এই শোক সহ্য করার তাওফিক দান করেন। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন, মানুষ নামের এই প্রজাতির পশুদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। ধর্ষকদের ঘৃণা করি ও বয়কট করি।

আছিয়ার মৃত্যুর সংবাদে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। তারা উভয়েই একই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারা স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমাদের বোন আছিয়া আর নেই। আছিয়ার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক।

বিচারহীনতা, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে যে ধ্বংসাবশেষ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, শিশু আছিয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে সেই বিচারব্যবস্থা আবার জেগে উঠুক। পুরো বাংলাদেশ বোন আছিয়ার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত।’

এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আছিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন। এদিকে, বোনের বাড়িতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে অবশেষে নিহত নিথর দেহ মাগুরায় নিজ গ্রামের বাড়িতে শিশু আছিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে মাগুরা স্টেডিয়ামে পৌঁছে তার মরদেহ। এর আগে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর থেকে সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার তাকে নিয়ে রওনা হয় স্টেডিয়াম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নেয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। ঘোষণা অনুযায়ী রাতেই নোমানী ময়দানে সন্ধ্যা ৭টায় তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার (৫ মার্চ) রাতে ভুক্তভোগী আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করে তার বোনের শ্বশুর, যাকে তার ছেলে সাহায্য করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৬ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। পরে তার মা হাসপাতালে আসেন এবং বিকালে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেই রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে শুক্রবার (৭ মার্চ) রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শনিবার সন্ধ্যায় তাকে ঢামেক হাসপাতালের পিআইসিইউ থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। পরে তার চিকিৎসার জন্য সিএমএইচের প্রধান সার্জনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়। এদিকে, মাগুরার একটি আদালত মামলার চার আসামিকে রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। আসামিরা হলেন- ভুক্তভোগীর বোনের শ্বশুর হিটু শেখ (৪২); তার বোনের স্বামী সজিব শেখ (১৮); শাশুড়ি জাহেদা খাতুন (৪৫); এবং ভাশুর রাতুল শেখ (২০)। নিরাপত্তাজনিত কারণে গত রোববার আসামিদের আদালতে হাজির করতে না পারায় গভীর রাতে শুনানি শুরু হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত