দেড় হাজার বছর আগের কথা। নবীজি (সা) যখন মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকছিলেন, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী সৎ ও সুন্দর জীবন পরিচালনার উপদেশ দিচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ বিমুখ কাফের মুশরিকরা চরম বিরোধিতায় নামে। সেই সাথে তখনকার ধর্মীয় মহল ইহুদী খ্রিস্টানরাও নানাভাবে শত্রুতায় লিপ্ত ছিল।
একবার ইহুদীদের কিছুলোক রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে জানতে চাইল, আপনি যে রবের কথা বলেন, আমাদের তার বর্ণনাটা দিন দেখি। আল্লাহ তো তাওরাত কিতাবে তার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন, (দেখি আপনার খোদার সাথে আমাদের খোদার মিল আছে কি না।) বলুন দেখি, তিনি কী জিনিস দিয়ে তৈরি, তিনি আহার করেন কি না, পানি পান করেন কীভাবে। এই দুনিয়া কী তিনি কারো কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন, কিংবা তার পরে উত্তরাধিকার কে পাবে। বিষয়গুলো পরিষ্কার করুন। কোনো কোনো বর্ণনায় এই প্রশ্নটি ছিল কুরাইশ কাফেরদের। তারা বলল, তোমার যে আল্লাহ, তার বংশতালিকাটা বলুন তো। আরেক বর্ণনায় এমন প্রশ্ন ছিল নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের। তাদের জিজ্ঞাসা ছিল, আপনার প্রভু কোন ধাতু দিয়ে তৈরি তা কি আমাদের বলবেন। নবীজি তাদের উত্তর দিলেন খুব শান্তভাবে। বললেন, আমার প্রভু তো কোনো বস্তু বা ধাতু নয়। এর প্রেক্ষিতে কোরআন মজিদের একটি ছোট্ট সূরা নাজিল হয়। অল্প কয়েকটি কথা। অথচ এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কিত যাবতীয় প্রশ্নের জবাব। সেটি ছিল সূরা ইখলাস। আল্লাহ পাক বলেন-
‘বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সবাই তার মুখাপেক্ষী; তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নাই।’ (সূরা ইখলাস)।
একত্ববাদের ঘোষণা। বহুত্ববাদকে নাকচ করা হয়েছে। আল্লাহ একের অধিক নন। পারসিকরা মনে করে, ভালোর খোদা একজন ইয়াযদান, মন্দের খোদা একজন আহরিমন। কিন্তু একই রাজত্বে দুজন প্রভুর কর্তৃত্ব হলে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যেত। সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে থাকত সমগ্র সৃষ্টিজগতে। খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদ বা তিন খোদায় বিশ্বাসও যুক্তি ও বাস্তবতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কাজেই আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়।
আমরা জীবন যাপনে নিত্যদিন একে অপরের মুখাপেক্ষী, এমন কোনে ব্যক্তি বস্তু বা শক্তি নাই, যা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সূর্যের আলো, চাদের আকর্ষণে জোয়ারভাটা, পানি বাতাস তরুলতা এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে জীবন জগত টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ। আল্লাহ তার মহান অস্তিত্ব ও কার্যালীর জন্য কারো প্রতি মুখাপেক্ষী নন, তিনি স্বয়ম্ভু। চির অমুখাপেক্ষী। আর অন্য সবাই তার মুখাপেক্ষী। আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানী ছাড়া দুনিয়ার কিছুই এক মুহূর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারে না।
প্রশ্ন ছিল তিনি কারো উত্তরাধিকার পেয়েছেন কি না। কিংবা তার পিতা কে? কার কাছ থেকে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তার সন্তান আছেন কিনা বা তার উত্তরাধিকার কে পাবেন। দুটি কথায় যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে, ‘তিনি জন্ম গ্রহণ করেননি বা তিনি কাউকে জন্ম দেন না।’ যে নিজে জন্ম গ্রহণ করে বা জন্ম দেয়, সে তো পিতা বা পুত্র হতে পারে, খোদা হতে পারেন না। এরপর কথা থেকে যায়, আল্লাহর বুঝি কোনো বিকল্প বা সমকক্ষ আছে। না, নাই। থাকতে পারে না। থাকলে তা দুই রাজার দ্বন্দ্বের পরিণতিতে সৃষ্টিজগতের ধ্বংস ডেকে আনবে।
মহান আল্লাহর পরিচয় মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তিনি নিজের পরিচয় যেভাবে দিয়েছেন সেটিই আসল। কোরআন মজিদের সূরা বাকারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আয়াতুল কুরসিতে আল্লাহ পাক নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
‘আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ্ নাই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যাকিছু আছে সমস্ত তাঁরই করায়ত্বে। এমন কে আছে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যাকিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যেটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারে না। তাঁর ‘কুরসী’ (আসন) আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত; এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না; আর তিনি মহান, শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৫৫)।
আল্লাহর নিরানব্বই নাম আছে। বলা হয় আসমাউল হুসনা। সুন্দরতম নামসমূহ। এই নামগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় মানব মনে উদ্ভাসিত হয়। এসব নামে মনোসংযোগ করলে সৃষ্টিজগতের রহস্যাবলি উদ্ভাসিত হয়। কম্পিউটারের ডেস্কটপে কতক ফাইলের চিহ্ণ থাকে আর কতক ফোল্ডারের। আর কতক আছে চার্চ ইঞ্জিন, আইকনও বলা হয়। আইকনের উপর যখন ক্লিক করা হয় একেকটি জগত খুলে যায়। আল্লাহর পবিত্র নামগুলো সেরূপ আইকনের মতো। যে কোনো একটি নাম নিয়ে ধ্যান ও মনোসংযোগ করলে তার ঝলকে অন্তর আলোকিত হয়। আধ্যাত্মিক রহস্যের দিগন্ত উন্মোচিত হয়। হাদিসে আছে, ‘আল্লাহর নিরানব্বইটি সুন্দর নাম আছে, যে এগুলো আয়ত্ব করবে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে।’