ঢাকা রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সংস্কার ও গণতন্ত্রে জোর জাতিসংঘের

সংস্কার ও গণতন্ত্রে জোর জাতিসংঘের

বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনের ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এতে দেশের গণতন্ত্র ও সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের ওপর জোর দেয়া হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে পাশে থাকার আশ্বাস দেন জাতিসংঘ মহাসচিব। গতকাল শনিবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে বক্তব্য রাখেন। প্রতিনিধিদের বক্তব্যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আগামীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ও টেকসই গণতন্ত্র নিশ্চিতে জাতিসংঘের সহযোগিতা চাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা ফুটে ওঠে।

গোলটেবিল বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা ও সংস্কার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো এজেন্ডা নেই। বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণকে সহযোগিতা করাই আমাদের এজেন্ডা। বর্তমান সংকটকালে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর পরিবর্তে জনগণের জন্য যথাযথভাবে অর্থ ব্যয়ের তাগিদ দেন তিনি।

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, বাংলাদেশের শান্তি ও সংলাপ প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সহায়তা করবে। কারণ বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের পথে এগোচ্ছে, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা, কারণ এটি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকে একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে জাতিসংঘ নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে থাকবে।

তিনি বলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশে থাকতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের নেতৃত্বে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আমি জানি জনগণ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সমৃদ্ধির এক নতুন ভবিষ্যতের আশায় রয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য এক সন্ধিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের লক্ষ্যে আপনাদের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করা। জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংস্কার অবশ্যই করতে হবে, সেই সংস্কারের কথা সবার আগে বলেছে বিএনপি। কিন্তু সেই সংস্কারটা যত দ্রুত করা যায়। আমরা যেটা বলেছি, মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয়গুলোর সংস্কার করে ফেলা, তারপর দ্রুত নির্বাচন করা, এরপর একটি সংসদের মাধ্যমে বাড়তি সংস্কারগুলো করা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটাই আমরা বলেছি।

নির্বাচন নিয়ে কোনো টাইম ফ্রেমের কথা বলেছেন কিস না জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের কোনো টাইম ফ্রেমের কথা বলার প্রয়োজন নেই। সংস্কার আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা সংস্কার কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলছি, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তারা যা চাচ্ছে আমরা সব দিয়ে দিচ্ছি। এরইমধ্যে আমাদের সঙ্গে একটা বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমরা আমাদের টাইম ফ্রেমটা দিতে যাব কেন?’ গোলটেবিল আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন বলেন, জাতিসংঘের তরফ থেকে বলা হয়েছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আপনারা বসে রিফর্মস কী নেবেন, সেটা ঠিক করেন। উনি বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর মধ্যে একটা নজির সৃষ্টি করবে আগামী নির্বাচন, এমনটা উনি আশা করেছেন।

টেকসই গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আমরা সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলেছি। একটা ফেয়ার নির্বাচনের বিষয়ে বলেছি, টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের অধিকাংশ বক্তব্য সমর্থন করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি আশাবাদী।

জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সংস্কার নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। সংস্কার ও গণহত্যার বিচারে জনগণের কাছে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কাজে দেবে না।

তিনি বলেন, সংস্কারের মৌলিক ভিত্তি এই সরকারের আমলেই তৈরি করতে হবে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কাজে দেবে না। এছাড়া, সংবিধান ও গণপরিষদ নিয়েও আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে একটি সংস্কারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটাই বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধানরা তাদের নিজ নিজ সংস্কার প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংস্কার বিষয়ে তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে জনগণের কাছে বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি হলো বিচার ও সংস্কার। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়েই তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি জনগণের কাছে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি, সংস্কারের যে ধারাবাহিকতা, তা বাস্তবায়নের জন্য জুলাই সনদে দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।

সংবিধান সংস্কার নিয়ে এনসিপির অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আমাদের অবস্থান হলো, গণপরিষদের মাধ্যমেই সংস্কার করতে হবে, অন্যথায় সংসদের সংবিধান সংস্কার টেকসই হবে না, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেও এটাই দেখতে পাই। আমরা আমাদের এই দলীয় অবস্থান সংক্ষেপে বলেছি। জাতিসংঘ মহাসচিবের চাওয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার যেন নিজেরাই সমঝোতায় আসে, একটা ঐকমত্যে আসে এবং একসঙ্গে কাজ করেন।

নির্বাচন প্রসঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, আমরা মনে করি এবং বলেছি, নির্বাচনকে আমরা একটি সংস্কারের প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি, সংস্কারের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি। কোনো রকম সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কাজে দেবে না। অন্যসব রাজনৈতিক দলও এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। এখানে মতপার্থক্য হচ্ছে, কোন সংস্কারটা কখন হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু হবে, নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে। আমরা মনে করি, জুলাই সনদের মধ্যে এর বাস্তবায়ন হলে যে মতপার্থক্যগুলো আছে, সেগুলো কেটে যাবে। আমরা ঐকমত্যে আসতে পারব।

সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি না, জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, এখানে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ ছিল না। সংস্কার বিষয়ে সামগ্রিক আলোচনা হয়েছে। গণপরিষদ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন টেকসই হবে না বলে মনে করে এনসিপি। সেই জায়গা থেকে আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাচ্ছি। সামনের যে জাতীয় নির্বাচন, সেটা একই সঙ্গে আইনপরিষদ ও গণপরিষদ নির্বাচন, পাশাপাশি আমরা বিচারের বিষয়টা বলেছি। বিচারের বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতা চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাদের কাছে বিচার ও সংস্কার বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছি। ধন্যবাদ জানিয়েছি। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, আমরা যেন নিজেরা ঐকমত্যে আসতে পারি। আমরা যদি নিজেরা ঐকমত্যে আসতে পারি, তারা তাদের জায়গা থেকে সহযোগিতা করবে। প্রসঙ্গত, ১৩ মার্চ বিকালে চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। দ্বিতীয় দিনে গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত