স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, ধর্ষণের বিচারসহ সাত দাবিতে বামপন্থি কয়েকটি সংগঠনের গণমিছিল স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় তারা দাবিগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তবে ইনকিলাব মঞ্চসহ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচি ঘিরে ‘উত্তেজনা’ তৈরি হলে তারা গণমিছিল স্থগিত করেন। তবে সমাবেশে গণজাগরণ মঞ্চের লাকি আক্তারকে দেখা যায়নি। এর আগে গত শুক্রবার রাতে ফেসবুকে কর্মসূচির কথা জানিয়ে যুক্ত হবার আহ্বান জানান লাকী আক্তার। এতে বিভিন্ন মহলকে প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়। গণমিছিলটি শহিদ মিনার থেকে টিএসসি পর্যন্ত হওয়ার কথা ছিল।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, আমাদের এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের গতকাল থেকে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বারবার করে ফোন দিয়ে বলা হয়েছে, আমরা যেন এ কর্মসূচি পালন সংক্ষেপ করি এবং পালন না করি। আমরা বলতে চাই, হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি বলেন, অবিলম্বে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে, অবিলম্বে মোট ভায়োলেন্সে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগ আমল থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকার আমলে যে হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার যথাযথ বিচার করতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি আরও বলেন, সমাবেশে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের যে গণমিছিল হওয়ার কথা ছিল; শহিদ মিনার থেকে টিএসসি পর্যন্ত, সে গণমিছিল আমরা স্থগিত করে আমাদের সমাবেশ সমাপ্ত ঘোষণা করছি। সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট একাংশের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- ১. মাগুরার শিশুসহ সব হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের বিচার করতে হবে। ২. ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অপসারণ করতে হবে। ৩. জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। ৪. মসজিদ, মন্দির, মাজারে হামলাকারী মব সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে। ৫. চট্টগ্রাম কোর্ট প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ, যৌথ বাহিনী দ্বারা শ্রমিক হত্যার বিচার করতে হবে। ৬. সাগর-রুনি, তনু, আফসানা, মুনিয়াসহ পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ আমলে সংঘটিত হত্যার বিচার করতে হবে। ৭. হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলা, লুটপাটের বিচার করতে হবে।
এদিকে বামপন্থিদের কর্মসূচির প্রতিবাদে শাহবাগে জমায়েত হয়ে শহিদ মিনারে পদযাত্রা দিয়েছিল ইনকিলাব মঞ্চ। বেলা ১২টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি শহিদ মিনার থেকে বামপন্থিদের সরে যেতে পাঁচ মিনিটের আলটিমেটাম দেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তারা পদযাত্রা নিয়ে শহিদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে গণমিছিল প্রত্যাহার করায় তারা পুনরায় শাহবাগে ফিরে যান। পরে শাহবাগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে কর্মসূচি ঘোষণা করে ২ দফা দাবি জানান ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীর উসমান হাদী। ইনকিলাব মঞ্চের দাবিগুলো হলো- ১. জুলাই, পিলখানা, শাপলা গণহত্যার বিচার করতে হবে। ২. গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
কর্মসূচি ঘোষণা করে শরীফ উসমান হাদী বলেন, শাহবাগ যারা ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটিয়েছে, তাদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। আমরা জানতে পেরেছি, দেশকে অস্থিতিশীল করতে আওয়ামী লীগ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের সামনে দেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে দেখাতে এই প্রচেষ্টা করছে শাহবাগীরা। আজকে যদি আমরা শাহবাগে অবস্থান না করতাম; তারা আবার শাহবাগ দখল করে আরেকটা শাহবাগ করতো। এদিকে শাহবাগ থেকে ‘ল তে লাকি, তুই হাসিনা তুই হাসিনা’ স্লোগান ধরে শাহবাগ থেকে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল করেছে চেতনায় শাপলা নামে একটি সংগঠন।
অপরদিকে, দেশে অব্যাহত ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছেন বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘ব্যর্থ’ মন্তব্য করে তার অপসারণেরও দাবি জানান তারা। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণমিছিলের উদ্দেশে জড়ো হন বাম নেতাকর্মীরা। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গণমিছিল স্থগিত করে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সাত দফা দাবি তুলে ধরেন তারা।
তাদের সাত দফা দাবি হলো- দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নিপীড়ন ও হত্যার বিচার করতে হবে; স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টকে অপসারণ করতে হবে; জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে; মন্দির-মসজিদ, মাজারে হামলাকারীদের বিচার করতে হবে; চট্টগ্রামে আইনজীবী আলিফ হত্যার বিচার করতে হবে; সাগর-রুনি, তনু, আফসানা, মুনিয়াসহ আওয়ামী আমলের সব হত্যার বিচার করতে হবে এবং হিন্দু ও আদিবাসীদের ওপর হামলা ও লুটতরাজের বিচার করতে হবে।
সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (একাংশ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ বলেন, ‘আমরা খুব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে লাখ লাখ নারী অংশ নিয়েছিল একটাই উদ্দেশ্যে। সেটা হলো, বৈষম্যহীনভাবে নারীর পথচলাকে সহজ করা এবং নারীর ওপর যত ধরনের সামাজিক বৈষম্য আছে সেগুলোকে বিলোপ করা, শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যকে বিলোপ করা।’ তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পরে সেই নারীদেরই লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। একটা মহল আমার ওড়না ঠিক আছে কি না, ঠিকমতো হাঁটছি কি না, কী খেতে পারব, কীভাবে চলব- সবকিছুই যেন নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নারীদের তারা মানুষ হিসেবে নয়, জড়বস্তু বা পণ্য হিসেবে দেখতে চান। আর তার বিরুদ্ধেই আজকে এখানে দাঁড়িয়েছি।’
মুক্তা বলেন, ‘এ দেশে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তনুকে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচার হয়নি। মুনিয়াকে ভুক্তভোগী করে হত্যা করা হলেও বিচার হয়নি। নুসরাতকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলার বিচারও আমরা পাইনি। প্রতি ১০ মিনিটে নাকি একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা অবাক হই, এ জন্যই কি আমরা নারীরা রাস্তায় নেমেছিলাম?’
‘৫ আগস্টের পরে শতাধিক মানুষকে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দেশে যেন আইন নাই, বিচার নাই, শাসনব্যবস্থা নাই। একটা সরকার যে আছে, তার নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সরকার যে আছে, গণঅভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট নিয়ে যে তারা ক্ষমতায় এসেছে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি।’
সভাপতির বক্তব্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা বলেন, ‘আমরা এই কর্মসূচি ঘোষণা করার পর একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী আমাদের কর্মসূচি নস্যাৎ করার, আমাদের এই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য নানা চক্রান্ত করছে। আমরা এটাও লক্ষ্য করছি, আমাদের এই ধর্ষণবিরোধী গণআন্দোলনকে পুঁজি করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরাও পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছে। আমরা উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হুঁশিয়ারি করে বলতে চাই, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে ব্যবহার করে আপনাদের যে বাসনা; বাংলাদেশের ছাত্র, যুব সমাজ সেটি পূরণ হতে দেবে না।’
‘আমরা যখন ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করছি, তখন একটা স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে আমাদের ট্যাগ দেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা নাকি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের জন্য মাঠে নেমেছি। ৫ আগস্টের পর থেকে যে মব সন্ত্রাস চলছে, সেটি বন্ধ করতে হবে। এই মব ভায়োলেন্সের মধ্য দিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে।’