ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাশে থাকার বার্তা দিয়ে ঢাকা ছাড়লেন গুতেরেস

পাশে থাকার বার্তা দিয়ে ঢাকা ছাড়লেন গুতেরেস

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগামীর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব চ্যালেঞ্জ ও গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশ দেখতে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। সফরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি সংস্কার কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, তরুণদের ভাবনায় আগামীর বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে, সরাসরি ধারণা পেয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগে প্রধান সহযোগী হিসেবে জাতিসংঘ পাশে থাকতে চেয়েছে। গতকাল রোববার চার দিনের সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে অ্যান্তোনিও গুতেরেস আশ্বাস দেন যে, বাংলাদেশের যে কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে পাশে থাকবে জাতিসংঘ।

জানা গেছে, জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকা ছাড়ার আগমুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তার এ সফরটি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের জন্য বেশ গুরুত্ব বয়ে এনেছে। কারণ, সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানরা নিজ নিজ কমিশনের সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় অবস্থান তুলে ধরে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে। সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, টেকসই গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এনসিপির চাওয়া গণপরিষদের সংবিধান সংস্কার। সংস্কার কমিশনগুলো বৈঠকে সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, সংস্কার প্রয়োজনীয়। জাতিসংঘ এতে পাশে থাকবে। সংস্কার কীভাবে, কতটুকু হবে- তা জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হয়ে করতে হবে।

গত শনিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের আয়োজনে বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে সাতটি দল অংশ নেয়। বৈঠকে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান আসাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। রাজনৈতিক নেতারা বৈঠকে নিজ নিজ দলের অবস্থান তুলে ধরেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা আসে। এখন আর্থিক সহায়তা কমায় অর্থনৈতিকভাবে চাপে আছে বাংলাদেশ। এই চাপ সামলানোর ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিবের সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার সফরটি শুধু রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি এদেশের সংস্কার কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং তরুণদের ভাবনা নিয়ে বৈঠক করেন। এসব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি ধারণা পেয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব।

গত শনিবার জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়। সৌহার্দ্যপূর্ণ এ বৈঠকে পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা করেন এবং শান্তিরক্ষীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে গেছেন। এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অ্যান্তোনিও গুতেরেস সঙ্গে ইউনূসের কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন গুতেরেস। এ থেকে বোঝা গেছে- অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনব্যবস্থার প্রতি জাতিসংঘের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সফরের তৃতীয় দিন শনিবার ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তরুণ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন অ্যান্তোনিও গুতেরেস। চার দিনের সফরে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য রেশন কমানো ঠেকাতে জাতিসংঘ সম্ভব সবকিছু করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এ বিশ্ব সংস্থার মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গত শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। এমন এক সময়ে গুতেরেস কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করলেন যখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের খাবারের রেশন কমে অর্ধেক হতে পারে বলে সতর্ক করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ সংস্কার ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রয়েছে। বাংলাদেশের এই সন্ধিক্ষণে শান্তি, সংলাপ ও ঐকমত্যে সহায়তার জন্য জাতিসংঘ তৈরি আছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এ দেশের জাতীয় অভিযাত্রার এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশে এসে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর পরিসরে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধির ভবিষ্যতের জন্য জনগণের আশাকে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের এমন ভাবনা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ব বহন করে। ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে। গত শনিবার ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিবের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা বোঝার জন্য, মহাসচিব যুবসমাজ, সুশীল সমাজ এবং সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন। তিনি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের প্রকৃত রূপান্তরের জন্য সংস্কার প্রক্রিয়ার জটিলতাগুলো উপলব্ধি করেছেন। গুতেরেস জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’। মহাসচিব বলেছেন যে, তিনি যা কিছু করতে পারেন, তার সবকিছু দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবেন এবং বাংলাদেশ ও এর জনগণের পাশে থাকবেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক হিসেবে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গণঅভ্যুত্থানে চালানো হত্যাযজ্ঞ জাতিসংঘকে তদন্তের আহ্বান জানায় ইউনূস সরকার। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান অনুযায়ী, অভ্যুত্থান দমনে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সহযোগীর ভূমিকায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো। শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশে আসেন গুতেরেস। জাতিসংঘ মহাসচিব ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একসঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত