ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বদর যুদ্ধ

ইসলামের যুদ্ধনীতি

ইসলামের যুদ্ধনীতি

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসে মুসলমানদের সঙ্গে মক্কার কুরাইশ বাহিনীর প্রথম সম্মুখ লড়াই হয়। এই যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ অসম এবং মুসলমানরা ছিল অপ্রস্তুত। মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজার। আর মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। মাত্র দুটি ঘোড়া আর ৭০টি উট সাথে ছিল মুসলমানদের। কিন্তু আল্লাহর একান্ত সাহায্যে মুসলমানরা অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে। মক্কার নেতৃস্থানীয় ৭০ জন্য সর্দার নিহত হয় আর ৭০ জন বন্দি হয় মুসলমানদের হাতে। মুসলমানদের পক্ষে শহীদ হন মাত্র ১৪ জন। ৬ জন মুহাজির আর ৮ জন মদীনার আনসার। প্রশ্ন হল, এই অসম বদর যুদ্ধ কি আক্রমণাত্মক ছিল, নাকি আত্মরক্ষার। প্রশ্নটি প্রকট এ কারণে যে, ইদানিং ইসলামী স্কলাররা বলছেন যে, বদর ময়দানে এত কম সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিপুল কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ হতে পারে না। তাছাড়া নবীজির সব যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক। মদীনাকে রক্ষার জন্য একবার তিনি উহুদের ময়দানে আত্মরক্ষার জন্য লড়েছেন। খন্দকের যুদ্ধে বিরাট বিশাল আরব বাহিনীর মোকাবিলার জন্য মদীনার সীমান্তে পরিখা খনন করে আত্মরক্ষা করেছেন। সবচে বড় কথা, তিনি কখনো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করেননি।

মহানবী (সা) কখনো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করেননি; সবসময় আত্মরক্ষার যুদ্ধ করেছেন এই বয়ানটি প্রায় সব ইসলামী বক্তা ও গবেষকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া কিন্তু খুবই মারাত্মক। এর একটি অর্থ দাঁড়ায়, মুসলমানদের সবসময় মার খেতে হবে, নিজেদের উদ্যোগে কোনো সশস্ত্র যুদ্ধ করতে পারবে না। যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তবেই যুদ্ধ করার অনুমতি আছে। এর দ্বারা প্রকারান্তরে ইসলামের যুদ্ধ নীতিকে অস্বীকার করা হয়। মুসলমানদের নিস্তেজ, নির্জীব ও মারা খাওয়া জাতি হবার দীক্ষা দেয়া হয়।

আমি বলিষ্ঠ ভাষায় বলতে চাই, ইসলামের যুদ্ধনীতি সবসময় আত্মরক্ষামূলক ছিল না। বা সবসময় আক্রমণাত্মকও নয়। বরং সবসময় প্রতিরক্ষামূলক। তার মানে সবসময় শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষা করেছে এমন নয়। বরং মহানবী (সা.)-এর প্রায় যুদ্ধ ছিল প্রতিরোধমূলক। তার মানে আক্রান্ত হওয়ার আগে গিয়ে শত্রুকে প্রতিরোধ করা। একে প্রতিরক্ষামূলক বলাই অধিকতর সমীচিন হবে। বদর যুুদ্ধের কথাই ধরা যাক। এই যুদ্ধে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগেই আক্রমণ করতে গেছেন, কুরাইশরা উপায়ান্তর না দেখে যুদ্ধ করেছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করার আগে, ইসলামের যুদ্ধনীতি নিয়ে আরেকটি তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনায় আনতে চাই। নবীজির উপর ওহী নাজিল হয়েছিল, তার চল্লিশ বছর জীবনে। অহি নাজিলের পর ১৩ বছর তিনি মক্কায় ইসলাম প্রচার করেন। এ সময় এমন কোনো নির্যাতন নিপীড়ন নেই, কুরাইশ কাফেররা যার স্টীমরোলার মুসলমানদের উপর চালায়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর আদেশে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান, ইতিহাসে এর নামই হিজরত।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মক্কায় থাকাকালীন এতো অত্যাচার, এতো নির্যাতন সত্বেও মুসলমানদের পাল্টা আক্রমণ বা সশস্ত্র প্রতি-উত্তর দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। মুসলমানের সংখ্যা যে কয়জনই হোক তারা কাফের নেতাদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা বা গেরিলা আক্রমণ চালতে পারত; কিন্তু সে অনুমতি দেয়া হয়নি। হিজরতের পর নতুন ভূখণ্ড ও নেতৃত্ব পাওয়ার পরই তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়ে কোরআনের আয়াত নাজিল হয়। (দ্র. সূরা হজ, আয়াত-৩৯)।

এতে প্রমাণিত হয়, সশস্ত্র যুুদ্ধের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের মালিক হতে হবে। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। একজন গণস্বীকৃত নেতা থাকতে হবে। এবং সেই ভূখণ্ডের সার্বভৌম মালিকানা চর্চার অধিকার থাকতে হবে। যেগুলো আধুনিক রাষ্টবিজ্ঞানেও বিবেচিত। এর আগে যদি সশস্ত্র আক্রমণের পথ বেছে নেয়া হয়, তাহলে সমাজে অরাজকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হবে। নামাজ রোজা হজ জাকাতের মতো চুরির শাস্তি হাতকাটা, জেনার শাস্তি পথর মেরে হত্যা বা একশ ঘা বেত্রাঘাত প্রভৃতি দণ্ডবিধি কার্যকর করাও ফরজ। কারণ এগুলোও আল্লাহর আইন ও বিধান। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা বিচার ব্যবস্থা যেখানে চালু নেই সেখানে ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে কেউ এসব দণ্ডবিধি কার্যকর করতে পারবে না। আমাদের দেশেও তা পালিত হচ্ছে না। কেউ যদি ব্যক্তিগত বা দলগত উদ্যোগে নিজেরাই দণ্ডবিধি কার্যকর করতে চায় তাহলে সন্ত্রাসে পরিণত হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে তার অনুমতি নেই। এই কথাটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে ধর্মের নামে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা আমরা দেখি।

বদর যুদ্ধের সূচনায় ছিল যুল-উশাইরা যুদ্ধ। নবীজি তার গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে সংবাদ পান যে, মক্কা থেকে একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। কুরাইশরা মক্কা ত্যাগকারী মুসলমানদের ধন সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল। কাজেই তিনি শত্রুর অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আঘাত করার পলিসি নেন। তিনি সিরিয়াগামী কাফেলার গতিরোধ করার জন্য ১৫০ বা ২০০ যোদ্ধা নিয়ে যুল উশায়রা পর্যন্ত অগ্রসর হন। যুল-উশায়রা যাওয়ার পর জানতে পারেন, কাফেলা কয়েক দিন আগে সে পথ অতিক্রম করে চলে গেছে। তখন তিনি বনি মুদলাজ ও নাদারকে শান্তিচুক্তির আওতায় নিয়ে আসেন। প্রায় একমাসকাল সেখানে অবস্থানের পর মদীনায় ফিরে যান। তিন মাস পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জানতে পারেন, সিরিয়া থেকে কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা ফিরে আসছে। সেই কাফেলার গতিরোধ করার জন্য তিনি অগ্রসর হন। ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বদর প্রান্তরে ভয়াবহ যুদ্ধের রূপ নেয়। কাজেই বলতে হবে বদর যুদ্ধ আত্মরক্ষার যুদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল শত্রুর অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আঘাত করার, প্রতিরক্ষার যুদ্ধ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত