মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বর্বর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ৬৬০ জন। গতকাল মঙ্গলবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৪০৪ জনের নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তবে গোষ্ঠীটির হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে জানানো হয়, নিহতের সংখ্যা ৪১৩। অনেকে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকায় নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এদিকে, হামলায় ৬৬০ জনের বেশি আহত ফিলিস্তিনিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বারশ জানিয়েছেন। গাজা যুদ্ধের কারণে অনেক হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক জানান। তিনি বলেন, গাজায় চিকিৎসা সুবিধার তীব্র ঘাটতি রয়েছে, ৩৮টি হাসপাতালের মধ্যে ২৫টি পরিষেবা বন্ধ রয়েছে।
ইসরাইলি আগ্রাসনে বিপুল সংখ্যক আহত এবং ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার জন্য আমাদের ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল, শয্যা এবং অস্ত্রোপচার রুমের প্রয়োজন বলে জানান তিনি। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে সাহরির সময় গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। গাজায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধের মধ্যে এই হামলা চালায় দখলদার ইসরাইললি বাহিনী। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার উত্তরাঞ্চল, গাজা সিটি, দেইর আল বালাহ, খান ইউনিস, রাফাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, নিহত মানুষের অনেকেই শিশু। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা বেশ কয়েকটি জায়গাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ পর্যন্ত এ হামলা অব্যাহত থাকবে এবং তা শুধু বিমান হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়। ওই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রচেষ্টা চালানো হলেও তা ব্যর্থ হয়। তখন থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা ছোট দলকে লক্ষ্য করে নিয়মিত ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছিল। তবে আজকের হামলার মাত্রা অনেক বেশি ছিল।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস বলছে, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভণ্ডুল করেছে। আর এর মধ্য দিয়ে গাজায় এখনো আটক থাকা ৫৯ জনের ভাগ্য অনিশ্চিত করে তুলেছে তারা।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের অভিযোগ, হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানাচ্ছে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘এখন থেকে ইসরায়েল সামরিক শক্তি বাড়িয়ে হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’ ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র বলেন, বিমান হামলা চালানোর আগে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা হামাসের মাঝারি পর্যায়ের কমান্ডার ও নেতৃত্বস্থানীয় কর্মকর্তা এবং সংগঠনটির মালিকানাধীন অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েল ও হামাসের আলোচক দল এখন দোহায় অবস্থান করছে। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির আওতায় গাজায় জিম্মি থাকা ৩৩ ইসরায়েলি ও ৫ থাই নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এর বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েল একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিনিময়ে গাজায় এখনও থাকা ৫৯ জিম্মিকে মুক্তি দেয়ার জন্য হামাসকে চাপ দিচ্ছে। এ যুদ্ধবিরতির আওতায় মুসলিমদের রোজার মাস ও এপ্রিল মাসে ইহুদিদের পাসওভার উৎসবের ছুটির পর পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে হামাস চাইছে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ অবসানের জন্য আলোচনায় বসতে। তারা চায়, মূল যুদ্ধবিরতির শর্তের সঙ্গে সংগতি রেখে ইসরায়েলি বাহিনীকে পরিপূর্ণভাবে গাজা থেকে প্রত্যাহার করা হোক।
হামাস বলেছে, ‘আমাদের দাবি, মধ্যস্থতাকারীরা চুক্তি লঙ্ঘন এবং তা ভণ্ডুল করতে নেতানিয়াহু ও ইহুদিবাদী দখলদারদের সম্পূর্ণরূপে দায়ী করুক।’
গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলতে ব্যর্থতার জন্য দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করেছে। প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চলাকালে বেশ কিছু বাধাবিপত্তি দেখা গেছে। তবে তা পুরোপুরি লড়াইয়ে রূপ নিতে পারেনি।
গাজায় ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। বিভিন্ন সময়ে তারা হামাসকে হুমকি দিয়েছে, জিম্মিদের ফেরত দিতে রাজি না হলে আবারও তারা লড়াই শুরু করবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গতকাল মঙ্গলবার ভোরে হওয়া ওই হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে বলেছে, গাজার অসংখ্য জায়গায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে থাকছে।
চিকিৎসাকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গাজা সিটির একটি ভবন এবং মধ্যাঞ্চলীয় গাজার দেইর আল বালাহ এলাকার কমপক্ষে তিনটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিস ও রাফার বিভিন্ন জায়গাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ১৫ মাসের যুদ্ধে গাজা উপত্যকা অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালায়। ইসরায়েলের হিসাব অনুসারে এ হামলায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছেন এবং ২৫১ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নৃশংস হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, এ হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। হামলায় উপত্যকার বেশিরভাগ বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।
এদিকে, গাজায় ভয়াবহ বিমান হামলা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছিল ইসরায়েল। হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র এ কথা জানিয়েছেন। ফক্স নিউজকের ‘হ্যানেটি’ শোতে এক সাক্ষাৎকারে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, গাজায় ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ও হোয়াইট হাউসের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছিল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গতকাল মঙ্গলবার ভোরে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে কমপক্ষে ২০০ জন নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খলিল আল দেকরান রয়টার্সকে নিহতের এ সংখ্যা জানিয়েছেন।
গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এটাই ছিল গাজায় ইসরায়েলের সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিমান হামলা।
হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েল একতরফা যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। হোয়াইট হাউসের ওই মুখপাত্র বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলেছেন, হামাস, হুতি, ইরান এবং অন্য যে কেউই শুধু ইসরায়েল নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও সন্ত্রাসের চেষ্টা করলে তাদের মূল্য দিতে হবে। নরক নেমে আসবে।’
এর আগে ট্রাম্পও হামাসকে সতর্ক করতে গিয়ে জনসমক্ষে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, হামাসকে গাজায় থাকা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে অথবা সেখানে নরক নেমে আসবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
হামাসের হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন। আরও প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
গাজায় প্রায় ১৭ মাস ধরে চলা যুদ্ধে সেখানকার ২৩ লাখ অধিবাসীর প্রায় সবাই এক বা একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সেখানে এখন তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটির অভিযোগ, গাজায় নতুন করে হামলা নেতানিয়াহু জিম্মিদের বলিদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে গাজায় ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। গাজায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধের মধ্যে এই হামলা চালালো দখলদার ইসরাইললি বাহিনী। নেতানিয়াহু বাহিনীর এ হামলাকে গাজায় আটক জিম্মিদের ইসরাইলের বলিদানের সঙ্গে তুলনা করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস।
হামাস নেতা ইজ্জত আল-রিশক এক বিবৃতিতে বলেন, গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করে নেতানিয়াহু আটক জিম্মিদের বলিদান এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতানিয়াহু সরকারের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে মনোযোগ সরাতে সংঘাতকে রাজনৈতিক ‘লাইফবোট’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করে হামাস।
এর আগে হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিলের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ এনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা বলেছে, নেতানিয়াহু ও তার ডানপন্থি সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর ফলে ইসরাইল গাজায় বন্দি অবশিষ্ট ইসরাইলি জিম্মিদের ‘একটি অজানা ভাগ্যের’ দিকে ঠেলে দিল।
গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় নারী, শিশু এবং বয়স্কসহ কমপক্ষে ৩৩০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
গাজায় হামলার পর এক বিবৃতিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, আমাদের জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসের বারবার অস্বীকৃতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফ ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে আসা সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জবাবে এই হামলা।
‘ইসরাইল এখন থেকে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে’ বলেও বিবৃতিতে বলা হয়। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, যতক্ষণ না আমাদের জিম্মিদের বাড়ি ফেরানো হয় এবং যুদ্ধে আমাদের সব লক্ষ্য অর্জন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা লড়াই বন্ধ করব না।’
হামাস এখনও ঘোষণা করেনি যে, তারা যুদ্ধ পুনরায় শুরু করছে, পরিবর্তে মধ্যস্থতাকারীদের এবং জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র ফক্স নিউজকে বলেন, গাজায় হামলা চালানোর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে ইসরাইল পরামর্শ করেছিল।