সরকারি দপ্তরগুলোয় কাজের গতি বাড়ানোর চেয়ে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় আলোচনা সভা, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ও সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি করছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চাকরিজীবীরা। যা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির পরিপন্থি।
সূত্রে জানা গেছে, এসব আন্দোলনের পেছনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উস্কানি ও ইন্ধন রয়েছে। তারা সরকারি কর্মচারীদের দাবিগুলো সামনে রেখে দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
জানা গেছে, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ এর পরিপন্থি। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ৩০ নম্বর বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী- সরকারের অথবা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পালনে জনসম্মুখে আপত্তি উত্থাপন করিতে বা যে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করিতে পারিবেন না। সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশ পরিবর্তন, বদলানো, সংশোধন বা বাতিলের জন্য অনুচিত প্রভাব বা চাপ প্রয়োগ করিতে পারিবেন না। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ভঙ্গ করে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের উপ-পরিচালক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদের বদলি ঠেকাতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কৃষি) অ্যাসোসিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা ও তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ ব্যানারে বেশকিছু শিক্ষার্থী ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তা অবরোধ করেন। রাস্তা অবরোধের কারণে ওই এলাকা ও তার আশপাশে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় ওই পথে চলা মানুষের। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) চারজন কর্মীকে এমআরটি পুলিশ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে অভিযোগ তুলে সোমবার কর্মবিরতি পালন করেন মেট্রোরেলের কর্মীরা। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধনসহ সবকিছু এক ছাতার নিচে আনতে স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে, ওই কমিশনের অধীনে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা না নেয়ার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ইসি সচিবালয় ও সারা দেশে নির্বাচনি অফিসের বাইরে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখতে দাবি জানান। আগামী ১৮ মার্চের মধ্যে বিদ্যমান আইন বাতিল করে এনআইডিকে নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যাস্ত করতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না দেখলে আজ বুধবার সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত বছরের ২৭ নভেম্বর সচিবালয়ের ভেতরে সচিবালয়ে ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিব পদে ক্যাডার বহির্ভূত কর্মচারীদের নির্দিষ্ট হারে পদোন্নতি পাওয়ার কোটা রয়েছে। কিন্তু ক্যাডার বহির্ভূত কর্মচারীরা বিগত দিনে সেটা পরিপূর্ণভাবে পাননি।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগকে কেন্দ্র করে গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা হয়। এ ঘটনায় ১৭ জন উপসচিবকে শাস্তি দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। এদের মধ্যে আটজনকে গুরুদণ্ড, চারজনকে লঘুদণ্ড ও পাঁচজনকে তিরস্কার করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ১৭ জন উপসচিবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সচিবালয়ের ভেতরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
জানা গেছে, ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ এর যে কোনো বিধান লঙ্ঘন ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর আওতায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী এ বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অসদাচরণের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আওতায় আসবেন। সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা বহির্ভূত আচরণের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর।
গত ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মহাসমাবেশ করা হয়। সমাবেশে ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ও নবম পে-স্কেল বাস্তবয়নসহ ৭ দফা দাবিতে টানা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার বকেয়া বেতনসহ কয়েক দফা দাবিতে রেল মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের অস্থায়ী টিএলআর শ্রমিকরা। সকাল ১১টার দিকে শ্রমিকরা রেল মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান নেন। এসময় মন্ত্রণালয়ের প্রবেশপথ ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখেন সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা। বাংলাদেশ রেলওয়ে অস্থায়ী টিএলআর অস্থায়ী (চার ডিভিশন) শ্রমিক ব্যানারে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। তাদের দাবির মধ্যে আছে- পাঁচ মাস থেকে ১১ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে। ২০২০ নিয়োগবিধি সংশোধন করে অস্থায়ী টিএলআর শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী করতে হবে। সব অস্থায়ী টিএলআর শ্রমিকের বেতন ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। আগের মতো চাকরিতে বহাল করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘সরকারবিরোধী চক্র’ উস্কানি দিয়ে সরকারকে বিব্রত ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে। এসব আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামীতে সরকারি কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।