মাতৃগর্ভের শিশুর সাথে একজন ফেরেশতার সংলাপের বর্ণনা দিয়েছেন মসনবি শরিফে মওলানা রুমি। মানব শিশুকে ফেরেশতা বলল, তুমি এখন আছ তোমার মায়ের উদরে, একেবারে সংকীর্ণ প্রকোষ্টে। এখানে তুমি চিরকাল থাকবে না। বড়জোর নয়, দশ মাস। তারপর যেতে হবে এমন জগতে তোমার মায়ের পেটের তুলনায় যা কোটি কোটিগুণ বড়। সেখানে সাগর আছে, আকাশ আছে, চাঁদ সূর্য আছে, হাঁটবাজার সংসার আরো কতকিছু আছে। মায়ের পেটে মানব শিশু এসব শুনে অবাক হয়ে যায়। সে কিছুতেই বিশাল জগতের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। এখনও যাদের চিন্তা দুনিয়ার জীবনে বন্দি, তারা পরকালের কথা, বেহেশত দোজখের বিশালতা, ভয়াবহতার বর্ণনা সহজে বিশ্বাস করতে চায় না।
নবীজি বলেছেন, পবিত্র রমজানে তোমরা জান্নাত নসীব হওয়া ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য বেশি বেশি দোয়া কর। তারাবিতে চার রাকাত শেষে মোনাজাতের যে রেওয়াজ আছে তাতে প্রথম দোয়া, ‘প্রভুহে! আমি তোমার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছি। এবং জাহান্নাম হতে তোমার কাছে আশ্রয় চাইছি।’ মুমিনের জীবন ভরের স্বপ্ন, মৃত্যুর পরে আমরা পরম সুখের জান্নাত লাভ করব, জাহান্নামের কঠিন আজাব হতে নিস্তার পাব।
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী চিরসুখের নিবাস জান্নাত আল্লাহ বরাদ্দ রেখেছেন তার নেক বান্দা, বন্ধুদের জন্য। সেখানে তারা সব ধরনের সুখ সম্ভোগ উপভোগ করবে। কোরআন মজিদে বর্ণিত-
‘স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদের প্রদক্ষিণ করা হবে। সেথায় রয়েছে সমস্ত কিছু, যা মন চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয়। সেথায় তোমরা চিরস্থায়ী হবে।’ (সূরা যুখরুফ, আয়াত-৭১)
জান্নাতের একটি বড় নেয়ামত, চিরন্তনতা ও অমরত্ব। জান্নাতে যারা যাবে তাদের মৃত্যু নেই। ধ্বংস নেই। দুনিয়ার যত দামি হোটেলে যাই, কিছুসময় পর তা ছেড়ে আসতে হয়। এই দুনিয়াও ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু জান্নাত, একবার ঢুকতে পারলেই হলো, আর বের হতে হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের তাদের প্রভু সুসংবাদ দেন যে, তাদের জন্য রয়েছে তার নিজের পক্ষ হতে রহমত, সন্তুষ্টি ও জান্নাতের নিবাস, যেখানে তারা স্থায়ী নেয়ামতরাজি উপভোগ করবে। (সূরা তাওবা, আয়াত-২১)
সবচেয়ে বড় নেয়ামত আল্লাহর সন্তুষ্টি, আল্লাহ পাক এক মুহূর্তের জন্যও বেহেশতবাসীর প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। হাদিস শরিফের বর্ণনা: ‘বেহেশতি লোকেরা যখন বেহেশতে প্রবেশ করবে, আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা কি আর কিছু চাও, আমি তোমাদের তা দিতাম। তারা বলবে, হে আল্লাহ! তুমি কি আমাদের চেহারাগুলো শুভ্রতায় উজ্জ্বল করোনি। তুমি কি আমাদের বেহেশতে দাখিল এবং দোজখ থেকে নাজাত দাওনি। তখনই পর্দা উন্মোচন করা হবে, তখন বুঝা যাবে, এমন কোনো জিনিস নেই, যা রাব্বুল আলামিনের চেহারার দিকে তাকানোর চেয়ে প্রিয় হবে। (মুসলিম)
জান্নাতের অন্যতম নেয়ামত, জান্নাতবাসীদের মনে কোনোরূপ কলুষতা কদুরতা থাকবে না, কোনো ক্লান্তি তাদের স্পর্শ করবে না। ‘যে ব্যক্তি জান্নাতে দাখিল হবে সে নেয়ামতে ডুবে থাকবে, তাতে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। তাদের জামা-কাপড় জীর্ণ হবে না। তাদের যৌবন কখনো ফুরাবে না। (মুসলিম)
যখনই যে জিনিস মন চাইবে সাথে সাথে সামনে হাজির হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, এবং সেখানে আছে যাকিছু তারা কামনা করে এবং যা চোখ জুড়ায়, আনন্দ দেয়, এবং তোমরা সেখানে চিরকাল থাকবে। (আয-যুখরুফ: আয়াত-৭১)
‘সেখানে বিচরণ করবে, আনতনয়না রমণী হুর। তাদের রূপের বাহার এমন যে, একজন হুর যদি এই পৃথিবীতে উঁকি দেয়, তাহলে পৃথিবী ও জান্নাতের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা আলোয় উদ্ভাসিত হবে। তাদের সুবাস পুরো পৃথিবী সুবাসিত করবে। তাদের মাথার ওড়নার মর্যাদাও দুনিয়া এবং দুনিয়াতে যাকিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।
‘মুত্তাকিরা থাকবে নিরাপদ স্থানে- উদ্যান ও ঝর্ণার মাঝে, তারা পরিধান করবে মিহি ও পুরু রেশমি বস্ত্র এবং মুখামুখি হয়ে বসবে। এরূপই ঘটবে; আমি তাদেরকে সঙ্গিনী দান করব আনতলোচনা হুর, সেথায় তারা প্রশান্ত চিত্তে বিবিধ ফলমূল আনতে বলবে। (সূরা দুখান, আয়াত-৫১-৫৫)
জান্নাতি রমণী হুরদের কথা তো জানা গেল। এই পৃথিবীর স্ত্রীদের অবস্থা কী হবে। বেহেশতে তাদের স্ট্যাটাস কেমন হবে? আল্লাহ তাদের হুরে আইন থেকেও তীব্র সৌন্দর্য দান করবেন। তারা হুরদের সর্দারণী হবে, আপন স্বামীর কাছে থাকবে সর্বোচ্চ মর্যাদা।
‘তাদের আমি সৃষ্টি করেছি বিশেষরূপে-তাদেরকে করেছি কুমারী, সোহাগিনী ও সম বয়স্কা, ডান দিকের লোকদের জন্য। (সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত:৩৫-৩৮)
জান্নাতের বাড়িঘর বাগানবাড়ির ধরন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুত্তাকিদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত, তাতে আছে নির্মল পানির নহর, আছে দুধের নহর, যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নহর, আছে পরিশোধিত মধুর নহর এবং সেথায় তাদের জন্য থাকবে বিবিধ ফলমূল আর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে ক্ষমা।’ (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত-১৫)
জান্নাতের বিশালতার ধারণা পাওয়া যায় এ আয়াতে। ‘তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমীনের ন্যায়, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।’ (আলে ইমরান: ১৩৩)