তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে। আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার পেছনেও তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের জাতীয় নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও স্বতঃস্ফূর্ত। আগের মতো একপক্ষীয় পাতানো ভোট হবে না। তারা বলছেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটে তরুণরা গেমচেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে।
জানা গেছে, এবার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে নতুন প্রায় চার কোটি ভোটার। তাদের ভোটের ওপর অনেকটা নির্ভর করবে আগামীতে কোনো দল শাসনভার গ্রহণ করবে বাংলাদেশের। চলতি বছরের ডিসেম্বর ও আগামী বছরের জুলাইকে সামনে রেখে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক মহলে চলছে ভোটের হিসাব-নিকাশ।
ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিভাগ আলোকিত বাংলাদেশকে জানায়, দেশে বর্তমানে ভোটার রয়েছে ১২ কোটি ৪৪ লাখ। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সের ভোটার রয়েছেন ৩ কোটি ৫ লাখ। ৩০ থেকে ৩৩ বছরের মধ্যে ভোটার রয়েছে ১ কোটি ৫১ হাজার। এর পরের অবস্থানে ৩৪ থেকে ৪১ বছরের মধ্যে ভোটার ২ কোটি ৫৩ লাখ ভোটার। এছাড়া ৪২ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত ভোটার রয়েছে ৪ কোটি। ৬০ বছরের উপরে রয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ ভোটার।
ইসি সূত্র জানায়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও নতুন দল নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে ইসি। এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদে ৬০ লাখ তরুণ ভোটার যুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে ইসি। এছাড়া ইসির অফিসগুলোতে এসে আলাদা করে ভোটার হচ্ছেন তরুণরা। আগে থেকে ভোটার তালিকায় ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে তিন কোটির ওপর তরুণ ভোটার যুক্ত রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ কোটি তরণ ভোটার আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাবনিকাশ চলছে। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার চাবি এখন তরুণ ভোটারদের হাতে। দলগুলোর ফোকাসও থাকবে বিপুলসংখ্যক এই তরুণের দিকে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই-আগস্টে তরুণরা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস গড়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন তারা। একইসঙ্গে আন্দোলনে নেমে যারা মারা গেছেন ও আহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ। সুতরাং আগামীতে বাংলাদেশে ফের যেন কোন ফ্যাসিস্ট সরকারের উত্থান না ঘটে, সেজন্য তরুণদের ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে সংস্কার ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বদিউল আলম আরও বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট শাসন আমলে যারা অন্যায় ও অবিচার করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে তরুণদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য আগামীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটার ভোট প্রয়োগে ভালো-মন্দের বিচার করবেন। আগের অবস্থার এখন পুরো উল্টো। এখন আর আগের মতো ভোট হবে না। তরুণরাই হবেন- আগামীর বাংলাদেশ পরিচালনার মূল চাবিকাঠী।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট দেবেন রাজধানীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এনামুল হক। তিনি বলেন, জীবনের প্রথম সবকিছুর অভিজ্ঞতা অন্যরকম। প্রথমবার ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় আছি। নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। কেমন প্রার্থীকে ভোট দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী জুরাইয়া কবির বলেন, তরুণ ভোটার হিসেবে এটাই যেহেতু আমার প্রথম ভোট, তাই আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। তরুণ প্রজন্ম ও দেশের জন্য যে দল ভালো কাজ করবে আমরা তাকে ভোট দেব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী সামিয়া রহমান এবারই প্রথম ভোট দেবেন। তার প্রত্যাশা, তিনি যেন নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন। সামিয়ার কথায়, আমি ভোট দিতে চাই। আমার গণতান্ত্রিক অধিকারের বহিঃপ্রকাশ করতে চাই। আমি যেন গিয়ে এটা না দেখি যে, আমার ভোট কেউ দিয়ে দিয়েছে।
অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এমন একটা সরকার আমি চাই, যে সরকার মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করতে পারে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা গুরুত্ব দেবে।
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোটার ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ জন এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ৩৬৯ জন। আর হিজড়া ভোটার রয়েছেন ৮৪৮ জন ছিলো। গত সংসদ ভোটে মাত্র ৪১ শতাংশ ভোট পরেছিল। এবার ভোটার তালিহালনাগাদের পর প্রায় ১৩ কোটি ভোটার ভোট দিতে পারবেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তবে এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি প্রবাসী ভোটার ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি তরুণদের জন্যও ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা উচিত। একই সঙ্গে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় শর্ত শিথিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতি এবং এ ক্ষেত্রে একক কিংবা যৌথ হলফনামার মাধ্যমে এই সম্মতির ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১৫০টি সুপারিশ পেশ করেছে, যার মধ্যে এই দুটি প্রস্তাব অন্যতম।
তরুণ ভোটারদের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিগত সময়ের মতো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট হবে না, ভোটের আচরণে পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনে কোন দল অংশগ্রহণ করল এবং কোন ধরনের প্রার্থীরা নির্বাচনে আছেন, এসবের উপর ভিত্তি করেই ভোটাররা ভোট দেবেন। আর ভোটের মাঠে তরুণ-বৃদ্ধ সকলেই ভোট দেবেন। মানুষ যাকে ভোট দেবে সেই জিতবে।