ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহ আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, যেখান থেকে গাজা উপত্যকায় বর্বর হামলা পরিচালিত হচ্ছে, ইসরায়েলের সেই নেভাতিম বিমানঘাঁটিতে সফল হামলা চালিয়েছেন তারা। হামলায় ‘ফিলিস্তিন-টু’ নামের হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করা হয়। মঙ্গলবার সশস্ত্র বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং গাজায় ইহুদিবাদী শত্রুদের অপরাধমূলক গণহত্যার জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি বলেন, ‘অভিযানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।’ এর আগে ইসরায়েলি সরকার দাবি করে, তারা ইয়েমেন থেকে ছোড়া একটি মিসাইল প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে।
এ সময় ইসরায়েলের দক্ষিণ অংশের বিভিন্ন এলাকায় আকাশ হামলার সাইরেন বাজানো হয়। ইয়েমেনের বিবৃতিতে সতর্ক করে বলা হয়, গাজায় হামলা বন্ধ না হলে আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলে বিস্তৃত পরিসরে হামলা চালাবেন তারা। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চলবে আর ইয়েমেন চুপ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, তা হবে না। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজায় আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে চলা সব অপরাধ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষকে রক্ষায় ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী তাদের সব সম্পদ উৎসর্গ করবে, ইনশাআল্লাহ।’
মার্কিন রণতরীতে চতুর্থ দফা হামলা : এদিকে, লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর ওপর আবার হামলা চালিয়েছে আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চতুর্থবারের মতো বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস হ্যারি ট্রুম্যান এবং অন্যান্য যুদ্ধজাহাজের ওপর হামলা চালালেন তারা। বাহিনীর মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বুধবার জানান, এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করা হয়, যা ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পিত আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। সামাজিকমাধ্যমে এক পোস্টে সারি লিখেছেন, এই অভিযান সফলভাবে লক্ষ্য অর্জন করেছে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘মার্কিন আগ্রাসন ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইয়েমেনের অটল সমর্থনকে থামাতে পারবে না এবং গাজায় হামলা ও অবরোধ বন্ধ না করা পর্যন্ত ইসরায়েলের ওপর হামলা চলতে থাকবে।’ ইয়েমেনের স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, বুধবার ভোরেও সাদা এবং বন্দর শহর হোদেইদাসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় মার্কিন হামলা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে শনিবার ইয়েমেনে বড় ধরনের বিমান হামলা শুরু করে মার্কিন বাহিনী। এতে কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হন। এদের মধ্যে পাঁচজন শিশুও রয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ।
মুসলিম ও আরব দেশগুলোকে সতর্ক করল হুথি : আনসার-আল্লাহ আন্দোলনের নেতা আবদুল মালিক আল-হুথি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যদি তাদের দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের পরাজিত করতে পারে, তাহলে তাদের হামলা থেকে অন্য দেশগুলোও রক্ষা পাবে না। তিনি বিশ্বের আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। মঙ্গলবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে আল-হুথি বলেন, ‘ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ নস্যাৎ করার কাজে সফল হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা অন্য দেশগুলোর ওপর অবাধে আগ্রাসন চালাবে।’
তিনি বলেন, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিগুলোকে বিশ্বাস করেন, তাদের স্বীকার করা উচিত যে ইসরায়েল প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের গ্যারান্টি থাকলেও। ইয়েমেনি নেতা সেসব আঞ্চলিক আরব রাষ্ট্রগুলোর দিকে ইশারা করে বলেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে অথবা স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা করছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও সৌদি আরব। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যমূলক যুদ্ধের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া একটি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার ভোরে গাজায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল; এরপরই এই মন্তব্য করলেন আল-হুথি।
ইসরায়েলি ও মার্কিন দূতাবাসগুলোর সামনে অবরোধের ডাক : বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি ও মার্কিন দূতাবাসগুলোর সামনে অবরোধ ও ব্যাপক বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে হামাস। মঙ্গলবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাস আরব ও মুসলিম বিশ্বসহ গোটাবিশ্বের মুক্ত চেতনাসম্পন্ন মানুষের প্রতি এই আহ্বান জানায়। গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশে এই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। হামাসের অভিযোগ, দখলদার ফ্যাসিবাদী সরকার আবারও গাজায় বর্বর আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে, যা মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় আইন লঙ্ঘন করছে। এরই প্রেক্ষিতে সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ইসরায়েল ও মার্কিন দূতাবাসগুলোর সামনে অবরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই অবরোধের লক্ষ্য হবে তেলআবিব ও ওয়াশিংটনের ওপর সব ধরনের চাপ সৃষ্টি করা। যাতে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসন বন্ধ হয়’।
ইসরায়েলি হামলায় ক্ষুব্ধ গুতেরেস : গাজা উপত্যকায় নতুন করে ইসরায়েলি তাণ্ডবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যুদ্ধবিরতি মেনে চলতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক্সে নিজের অ্যাকাউন্টে দেয়া এক পোস্টে গুতেরেস বলেন, ‘আমি যুদ্ধবিরতি মেনে চলার, নিরবচ্ছিন্ন মানবিক সহায়তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এবং আটক থাকা অবশিষ্ট বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য জোরালোভাবে আবেদন করছি।’ এদিকে, গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে বোমাবর্ষণের নিন্দা জানিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ এবং বিভিন্ন মানবিক সংস্থা। বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। এই নিন্দা ও সমালোচনার মধ্যেই ইসরায়েলি হামলায় গাজায় আরও এক নারী ও তার শিশুসন্তান নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গাজা থেকে আলজাজিরা অ্যারাবিকের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, খান ইউনিসের পশ্চিমে একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক নারী ও তার শিশুসন্তান নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন।