পরকালের তিনটি ঠিকানার নাম জান্নাত, আরাফ ও জাহান্নাম। চিরন্তন সুখের সব আয়োজন থাকবে জান্নাতে। নবী অলি ঈমানদারদের জন্য অপেক্ষায় আছে এই বেহেশত। কাফের মুশরিক আল্লাহর নাফরমানদের শেষ গন্তব্য জাহান্নাম। যত কষ্ট, যত শাস্তি ও যন্ত্রণা হতে পারে সবকিছুর কারাগার জাহান্নাম। এই দুইয়ের মাঝখানে একটি অবস্থানস্থল আছে, নাম আরাফ। ট্রাঞ্জিটের সাথে তুলনা করা যায় আরাফের। যাদের ভালো-মন্দ সমান সমান তারা আরাফে অবস্থান করবে। শেষ গন্তব্য পরে নির্ধারিত হবে।
বেহেশতের সংখ্যা আটটি। (১) জান্নাতুল ফিরদাউস (২) জান্নাতুন নাঈম (৩ ) জান্নাতুল মাওয়া (৪) জান্নাতুল আদন (৫) দারুস সালাম, (৬) দারুল খুলদ (৭) দারুল মাকাম (৮) দারুল কারার।
নবীজি বলেন, তোমরা যখন আল্লাহর কাছে চাইবে, সর্বোত্তম জান্নাতুল ফেরদৌসের জন্য দোয়া করবে। বেহেশত বুঝি চাইলেই পাওয়া যাবে, নচেত চাওয়ার জন্য এত তাগাদা কেন। জান্নাত লাভের দোয়া করার শিক্ষা ও তাগাদা প্রমাণ করে, আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এবং চাইলে পাওয়া যাবে।
আরাফের ট্রাঞ্জিট : চিরসুখের জান্নাতের বিপরীতে আছে ভয়াবহ জাহান্নাম। মাঝখানে একটি জায়গার নাম আরাফ। জাহান্নাম এবং জান্নাতের মধ্যে একটি উঁচু প্রাচীরের ন্যায়, যাতে একটি দরজা রয়েছে। এই উঁচু প্রাচীরে এমন লোকেরা বাস করে যারা জাহান্নামের ভয়াবহতা এবং জান্নাতের শান্তিময়তা উভয়ই দেখতে পায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে চায়, কিন্তু তাদের পাপ ও পুণ্য সমান সমান হওয়ায় প্রবেশ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। কোরআন মজিদে একটি সূরার নাম আরাফ। এই সুরার কয়েকটি আয়াতে আরাফের চিত্রপট অঙ্কিত হয়েছে এভাবে।
‘উভয়ের মধ্যে আড়াল আছে। আরাফের মধ্যে কিছুলোক থাকবে, যারা প্রত্যেককে লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা জান্নাতবাসীকে সম্বোধন করে বলবে, ‘তোমাদের শান্তি হোক’। তারা তখনো জান্নাতে প্রবেশ করে নাই। কিন্তু প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা করে। যখন তাদের দৃষ্টি দোজখবাসীদের প্রতি ফিরিয়ে দেয়া হবে, তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিমদের সঙ্গী করো না। আরাফবাসীরা যে লোকদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে, তাদের বলবে, তোমাদের দলবল ও তোমাদের অহংকার কোনো কাজে আসল না। (সূরা আরাফ, ৪৬-৪৮)।
জাহান্নাম প্রসঙ্গ : জাহান্নাম সাতটি। ১. জাহীম ২. হুতামাহ ৩. হাবিয়া ৪. লাযযা ৫. সাঈর ৬. সাকার ৭. আন-নার।
জাহান্নাম ফারসিতে দোযখ, বাংলায় নরক। যত প্রকার শাস্তি, দুঃখ কষ্ট হতে পারে সবকিছুর ব্যবস্থা জাহান্নাম। যারা আল্লাহর অবাধ্য কাফের মুশরিক ছিল, আল্লাহর ক্ষমা পায়নি তারা জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। তবে যাদের অন্তরে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ থাকবে, বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ভোগ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। আমরা এখানে কয়েকটি হাদিসের ভাষ্য উল্লেখ করছি।
জাহান্নামের নিজস্ব একটি অবয়ব থাকবে, তাকে হাজির করা হবে কেয়ামতের ময়দানে। ‘জাহান্নামকে কেয়ামতের ময়দানে আনা হবে, যা ৭০ হাজার ফেরেশতা ৭০ হাজার শিকল দ্বারা (বেঁধে) টেনে উঠাবে।’ (মুসলিম: ২৮৪২)
দুনিয়ার আগুনের সাথে জাহান্নামের আগুনের তুলনা কেমন হবে
‘দুনিয়ার আগুন থেকে জাহান্নামের আগুনের তাপ সত্তর গুণ বেশি। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ দুনিয়ার আগুনই তো শাস্তি দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি উত্তর দিলেন, এর তাপ দুনিয়ার আগুনের ওপর ৬৯ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। প্রত্যেকটিই এর মত গরম।’ (বোখারি, ৩২৬৫)
আবু হুরইরা (রা)-এর বর্ণনায় জাহান্নামের ভয়াবহত।
‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে হাজির ছিলাম হঠাৎ আমরা একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি বলেন, তোমরা কি জান এটা কিসের শব্দ? আমরা বললাম আল্লাহ ও তার রাসূল এ ব্যাপারে বেশি জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা জাহান্নামের একটি পাথরের শব্দ, যা আল্লাহ ৭০ বছর পূর্বে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছিলেন, আজ তা জাহান্নামের শেষ প্রান্তে পৌঁছল।’ (মুসলিম : ২৮৪৪)।
‘ইবন আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনায় নবীজি বলেন, ‘যদি জাহান্নামের যাক্কুম ফল দুনিয়াতে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তার দুর্গন্ধে দুনিয়াবাসীর জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমদ, ১/৩০১)।
নু’মান ইবন বশীর (রা.)-এর বর্ণনায় নবীজি বলেন, ‘জাহান্নামে যাকে সব চেয়ে কম শাস্তি দেয়া হবে, তাকে জাহান্নামের দু’টি স্যান্ডেল পরিধান করানো হবে যার ফিতাদ্বয় হবে আগুনের। তার উত্তাপে মাথার মগজ টগবগ করতে থাকবে ডেগের ফুটন্ত পানির ন্যায়। সে মনে করবে তাকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মূলত তাকে সবচেয়ে কম শাস্তি দেয়া হচ্ছে।’ (বোখারি, ৬৫৬১)।
হাসান বছরী (রা.) বলেন, ‘তোমাদের ওই জাহান্নামীদের সম্পর্কে কী ধারণা, যারা ৫০ হাজার বছর পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেখানে তারা কোনো খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না এবং এক ফোঁটা পানিও পান করতে পারবে না। পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হবে। তাদের পেট ক্ষুধায় আগুনের মত জ্বলতে থাকবে। অতঃপর তাদের জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, আর সেখানে তাদের ফুটন্ত গরম পানি পান করনো হবে। যার উত্তপ্ততার কোনো তুলনা নেই, যে উষ্ণতা ও উত্তপ্ততা পরিপক্বতা পেয়েছে।’ (বোখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুল কারী, ২৮/৪৮৩)।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর রহস্যময়তা সম্বন্ধে আমরা অনেক শুনেছি, সে রহস্যের জট এখনো খুলতে পারেনি। এর সাথে তুলনা করলে পরকালে জাহান্নাম সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো বিশ্বাস করতে অবিশ্বাসীদেরও কষ্ট হবে না। জাহান্নামের শাস্তির বিশেষত্ব হলো, এই শাস্তি অবিরাম চলবে, কঠিন শাস্তিতে মানুষ মারা যাবে; কিন্তু সে মরেও মরবে না। অবিরাম অনন্তকাল চলতে থাকবে। নবীজি বিশেষ করে রমজানে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য দোয়া করার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনান নার।