ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঐক্যে সুবাতাস, আছে দ্বিমতও

ঐক্যে সুবাতাস, আছে দ্বিমতও

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন আলোচনার শীর্ষে রয়েছে সংস্কার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কেউ কেউ বলছে আগে সংস্কার পরে নির্বাচন। আবার কেউ কেউ এও বলছে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেবে। ওই নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা বাকি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে শুরু হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ। এরইমধ্যে ঐকমত্যে সুবাতাস বইছে, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমতও আছে। এরইমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের প্রথম দিন নিজেদের মতামত ও অবস্থান তুলে ধরেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। দলটির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্নমালার যে স্প্রেডশিট পাঠিয়েছে, তার মধ্যে ১২০টির বিষয়ে এলডিপি একমত। বাকি ৪২টি প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত নয়। দুটো প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে তারা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কোন কোন প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত বা একমত নয়, তা খোলাসা করেননি অলি আহমেদ। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এলডিপির এই বৈঠক হয়।

কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ এবং সদস্য পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন সংলাপে। এছাড়া ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। অলি আহমেদের নেতৃত্বে এলডিপির ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন-মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নেয়ামূল বশির, আওরঙ্গজেব বেলাল, কেকিউ সাকলায়েন, ওমর ফারুক, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মাহবুবুর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব বিল্লাল হোসেন মিয়াজী। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অলি আহমেদ বলেন, সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত ৭০টি প্রস্তাবের মধ্যে ৫১টিতে এলডিপি একমত, ১৬টিতে একমত নয়, একটিতে আংশিকভাবে একমত এবং দুটো প্রস্তাব অস্পষ্ট বলে তারা মনে করেন। বিচার বিভাগ সংস্কারের ২৩টি প্রস্তাবের মধ্যে ২২টির বিষয়ে এলডিপি একমত, একটির সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের ২০টি প্রস্তাবের সবগুলোর সঙ্গেই একমত এলডিপি। জনপ্রশাসন সংস্কারের ২৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে এলডিপি একমত, ১৫টিতে একমত নয়। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ২৭ প্রস্তাবের মধ্যে ১৬টিতে একমত এবং ১১টিতে একমত নয় বলে কমিশনকে জানিয়েছেন এলডিপি। অলি আহমেদ বলেন, সবগুলো সুপারিশের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের সুপারিশ দুর্বল ছিল। তারা অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করেছিল তার কাগজ সংগ্রহ করা উচিত ছিল।

সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে দুই ধরনের সরকারি কর্মকর্তার ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আপনি যত কিছুই করেন না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবেন না যদি দুইজন লোক কাজ না করে, একজন ওসি, আরেকজন হল ইউএনও।

সংস্কার বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব জমা দিয়েছে জামায়াত: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার সুপারিশের ওপর মতামত জমা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের কাছে সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে নিজেদের মতামত জামা দেয় জামায়াত। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল লিখিত মতামত জমা দেয়।

সংস্কার প্রস্তাব জমা শেষে সাংবাদিকদের মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশন- এই পাঁচ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর জামায়াতে ইসলামীর মতামত আমরা লিখিত দিয়েছি। এই পাঁচ বিষয়ের ওপর সুপারিশ দলের নেতৃবৃন্দ, আইন বিশেষজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আমাদের টেকনিক্যাল টিম যথেষ্ট সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য, যথার্থ ও উপযুক্ত করার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চায় একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেজন্য সরকারের সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছি। নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোতে যে ভারসাম্যহীনতা-সেগুলো ফিরিয়ে এনে সমন্বিত করতে ভালো কিছু পরামর্শ দিয়েছি।

আগামী রোববার সংস্কার প্রস্তাবের মতামত ঐকমত্য কমিশনে জমা দেবে বিএনপি : আগামী রোববার বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবের মতামত ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।

আমির খসরু বলেন, সংস্কারের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য হবে সেগুলোকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। আর যেসব বিষয়ে দ্বিমত তৈরি হবে সেগুলা নিয়ে আগামী নির্বাচনে সবাই জনগণের কাছে নিয়ে যাবে। এরপর সংসদে আলোচনা, তর্ক-বির্তক হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অবস্থান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে যেটা আলোচনা হয়েছে, সেটা হলো আগামী নির্বাচন। সংস্কারের ব্যাপারে সবগুলো বিষয় নিয়ে যে ঐকমত্য কমিশন হয়েছিল সেগুলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আমির খসরু বলেন, সবাই তো ধরে নিয়েছে ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনেকের মতে ডিসেম্বর অনেক দেরি, তারপর ডিসেম্বর শেষ সময় ধরে নিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে আমরা সঠিক পথে থাকব, গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কমফোর্ট ইরোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার শেরেবাংলা নগরে সংসদ ভবনের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ের সভাকক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতিসহ বিবিধ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হচ্ছে। ঈদের আগে অন্ততপক্ষে ৪টি দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। ঈদ ছুটি শেষে পর্যায়ক্রমে বাকি দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, বিভিন্ন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট মতামত জানতে এরইমধ্যে স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কমিশন মতামত পেয়েছে। এ সময় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশীয় কর্মসূচির পরিচালক পিয়েরে প্রকাশ এবং প্রতিষ্ঠানটির মিয়ানমার ও বাংলাদেশীয় সিনিয়র কন্সালট্যান্ট থমাস কেন উপস্থিত ছিলেন।

সংস্কার না হলে আবারও দুঃশাসন ফিরে আসবে- আলী রিয়াজ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, রাজনৈতিক, সুশাসনসহ সব বিষয় মাথায় রেখে বিদ্যমান কাঠামোর সংস্কার দরকার। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়েই জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হবে। তিনি বলেন, সংস্কার না হলে স্বৈরতন্ত্র মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। এতে আবারও দুঃশাসন ফিরে আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার।

আলী রীয়াজ বলেন, আমরা দেখেছি নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছিল। আবার বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, এটা গণতান্ত্রিক নয়। বিচারহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে দরকার সংস্কার। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। তিনি বলেন, বিদ্যমান কাঠামোর সংস্কার দরকার। সংস্কার না হলে স্বৈরতন্ত্র মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। এতে আবারও দুঃশাসন ফিরে আসতে পারে। আলী রীয়াজ বলেন, বিগত ১৬ বছরে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সঠিক গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার কারণে দুর্বল ও ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে দেয়নি। তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেন সংস্কার করতে হবে, কারা তুলেছে এ সংস্কারের প্রস্তাব। এটা মূলত এসেছে জনগণের কাছ থেকে, তাদের ক্ষোভণ্ডবিক্ষোভ থেকে এসেছে। এখন কাঠামোগত বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করা যাবে না। বারবার ফিরে আসবে। তাই সংস্কারের প্রস্তাব বা সংস্কার দরকার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত