ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা বিজয়

সাধারণ ক্ষমার তথ্যবিভ্রাট

সাধারণ ক্ষমার তথ্যবিভ্রাট

এক দশক আগে গণতান্ত্রিকভাবে মিসরের ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। তিনি ছিলেন ইসলামপন্থী, উদার এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সমর্থনপুষ্ট। তার চরমবিরোধী ছিলেন মিসরের সেনাবাহিনী প্রধান সিসি। মুরসি এক বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল চরম শত্রু সিসিকে তিনি ক্ষমা করে পুনরায় পুনর্বহাল করেন। সিসি শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলায়, তার সমর্থক শত শত মানুষকে রাজপথে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামপন্থিদের দমন করে।

আমাদের দেশে গত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন ঘটে। হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সবচে বেশি নিপীড়ন চালায় একটি বড় ইসলামী দলের উপর। হত্যা, গুম তো আছেই, ওই দলের শীর্ষস্থানীয় সব নেতাকে বিচার প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলায়, কিংবা জেলখানায় মৃত্যু নিশ্চিত করে। হাসিনার পতন ছিল সমগ্র দেশবাসীর মতো দলটির নেতাকর্মীদের জন্য আনন্দের বার্তা। কিন্তু দেখা গেল, দলের শীর্ষনেতা ঘোষণা করে বসলেন, আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমা করে দিয়েছেন। তদুপরি শেখ হাসিনাকে রাজনীতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনি দেশ ছেড়ে ভারত পালিয়ে গেলেন কেন? এই বক্তব্যে ততক্ষণাৎ দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। একপক্ষ বলল, দলের অগণিত নেতাকর্মীকে হত্যা গুম ও ফাঁসিতে ঝুলানোর জঘন্য অপকর্ম তিনি কীভাবে মাফ করে দিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনার পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর গুলিতে হাজারো ছাত্র জনতা নিহত ও পঙ্গু হওয়ার অপরাধ থেকে শেখ হাসিনাকে নিষ্কৃতি দেয়ার তিনি কে। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা কী নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে বা ক্ষমা চেয়েছে? তাহলে ব্যাপারটি কী হাস্যকর হল না? নেতার গুণমুগ্ধদের ভাষ্য ছিল, নবী করিম (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন মক্কার চিরশত্রু কাফেরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের নেতাও সেই আদর্শ অনুসরণে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। অবশ্য তিনি বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বুঝতে পেরে নিজের বিবৃতি থেকে ফিরে আসেন।

আজ ২০ রমজান মক্কা বিজয়ের দিন। রাজনীতির অঙ্গনে দেশের ও মিসরের দুটি ঘটনা উল্লেখ করে আমরা মক্কা বিজয়ের সাধারণ ক্ষমার তাৎপর্যটি বিশ্লেষণ করতে চাই, যাতে ইসলামপন্থীরা ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়ে শত্রুর সাথে বারবার আঁতাত না করে। ১৯৯৬ সালে উদারতার নামে একই খেসারত দেয়ার পরও হুঁশ ফিরেনি, আফসোস এখানে।

মক্কা বিজয় নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে যে বয়ানটি দেয়া হয়, তাহল মহানবী (সা) মক্কাবাসীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, এটিই নবীজির সুন্নাত, শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়া ইসলামের আদর্শ।

৮ম হিজরির ১০ রমজান সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে নবীজি মদীনা ত্যাগ করেন। ১০ দিনের সফর শেষে তিনি মক্কার অদূরে তাঁবু স্থাপন করেন। দীর্ঘদিন মদীনার কোনো সংবাদ না পাওয়ায় উদ্বিগ্ন কুরাইশ সরদার আবু সুফিয়ান রাতে ঘুরতে বের হয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে। বিশাল প্রান্তর জুড়ে তখন রান্নাবান্নার আগুন জ্বলছে। নবীজির চাচা আব্বাস (রা.) তাকে দেখে ফেললে তিনি আবু সুফিয়ানকে নবীজির সামনে হাজির করেন। সেখানে অপারগ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজি আবু সুফিয়ানের সম্মানের প্রতি খেয়াল রেখে ঘোষণা দেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, যে আল্লাহর ঘরের গিলাফের মধ্যে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ। যে নিজের ঘরের মধ্যে অন্তরীণ হয়ে থাকবে সে নিরাপদ।

আশ্রয় নেয়ার অর্থই ছিল, নিজের দোষ স্বীকার করা, পরাজয় মেনে নেয়া। লক্ষ্য করুন, মক্কার উপকণ্ঠে এসেই মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে নবীজি ক্ষমা ঘোষণা করেননি। কোন অপরাধীকে যদি অপরাধ স্বীকারের আগে ক্ষমা করে দেন, উপহাস করে সে বলবে, আমি কী আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আমাকে ক্ষমা করার আপনি কে?

এক প্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা জয় হলো। নবীজি কাবাঘরে প্রবেশ করে শিরকের চিহ্ন মূর্তিগুলো বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন। তারপর জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সামনে কুরাইশ জনতা, যারা পরাজিত, পদানত, যারা তাকে নানা নির্যাতন করে স্বদেশভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল।

তিনি চাইলে বলতে পারতেন, আমি তোমাদের মাফ করে দিলাম। তিনি জানতে চাইলেন, তোমরা আজ আমার কাছে কেমন আচরণ আশা করেন। পরাজিত ও ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে সমস্বরে বলল, কল্যাণময় আচরণ। আপনি হলেন সম্ভ্রান্ত ভাই, সম্ভ্রান্ত ভাইয়ের সন্তান। রাসূল (সা.) তখন বললেন, ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের যে কথা বলেছিলেন, আজ আমি তোমাদের সঙ্গে সে কথাই বলব। আপনারা যান, আপনারা মুক্ত।

ইউসুফ (আ) এর সৎভাইয়েরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তারা ইউসুফের সম্মুখে হাজির হয়ে পরাজয় মেনে দোষ স্বীকার করলে ইউসুফ (আ.) তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিনও নবীজি একই কাজ করেন এবং ঘোষণা করেন, আজকে আপনাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না। আপনারা মুক্ত।

এই হল, মক্কা বিজয়ে নবীজির সাধারণ ঘোষণার প্রেক্ষাপট। কাজেই মক্কা বিজয় ও সাধারণ ক্ষমার ঘটনাকে নিজস্ব অদূরদর্শিতার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখানোর সুযোগ কারো নেই। কারণ, নবীজি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও ১৫ জন জঘন্য অপরাধীকে তিনি ক্ষমা করেননি। হত্যাযোগ্য অপরাধী হিসেবে তাদের চিহ্ণিত করেন। এদের মধ্য থেকে যাদের হত্যা করা হয় তারা ছিল, আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল, আবদুল্লাহর দুই বাঁদি থেকে একজন, সারাহ, হুয়াইরিস ইবনে নুকাইদ, মিকয়াস ইবনে সুবাবা এবং হারিস ইবনে তুলাতিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত