ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এতেকাফ

লাইলাতুল কদর লাভের সাধনা

লাইলাতুল কদর লাভের সাধনা

আমাদের দেশে শীতের শেষভাগে তরুণদের মনে প্রেরণা জাগে আনন্দ ভ্রমণের। কক্সবাজার বা পর্যটন স্পটগুলো তখন সরগরম হয়ে যায়। প্রত্যেকে চায় দুই একটা দিন বা কিছু সময়ের জন্য নিঃসর্গের কোলে সাগর তীরে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই।

মনে শান্তি-সুখের আমেজ মাখার চেতনা মানুষের সহজাত। আনন্দ ভ্রমণে মানুষের দেহ ও জৈবিক মন আনন্দে মজে থাকার সুযোগ পায়। বস্তুবাদিরা দেহগত এই ভোগ ও আনন্দকে জীবনের লক্ষ্য ও সাফল্য বলে মনে করে। ভোগের এই আনন্দ যখন লাগামহীন হয়, তখন লোভে পরিণত হয়। মনের মধ্যে জগতটাকে লুটেপুটে খাওয়ার তাড়নার সৃষ্টি করে। দুনিয়াতে যত হানাহানি, লোভের তাণ্ডব, আরো পাওয়া আরো খাওয়ার নেশা তার মূলে আছে জৈবিক তাড়না ও ভোগের উন্মত্ততা। এর থেকে নিস্তার পেতে হলে মানুষকে আত্মিক শক্তির উজ্জীবন ঘটাতে হবে। তখনই তার মধ্যে মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ও উজ্জীবন হবে। মানবীয় এই বিকাশ ও উজ্জীবনের জন্য এসেছে ধর্মীয় অনুশাসন।

মানুষের আত্মিক উন্নতির জন্য নানা ধর্ম, নানা ফর্মুলা দিয়েছে। কোথাও সংসার ত্যাগী বৈরাগী হওয়ার কঠোর সাধনার কথা বলা হয়েছে। কোথাও বিয়ে-শাদীর মতো অতিশয় মানবীয় চাহিদাকে অস্বীকার করে পুরোহিত হওয়ার পথ বাৎলানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তব জরিপে দেখা যাবে, অত্যন্ত কদর্য ও অমানবিক সব কাজকর্মকে ধর্মের নাম দেয়া হয়েছে।

ইসলাম মানুষের আত্মিক উন্নতির যে পথ দেখিয়েছে, তা মানবীয় চাহিদার সাথে সঙ্গতিশীল ও স্বভাবসম্মত। ঘোষণা করেছে ‘ইসলামে বৈরাগ্যের স্থান নেই।’ সংসার ও সংযম সমানতালে মুসলমানের জীবনে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন করে। ইসলামের সবগুলো বিধানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তই পাওয়া যাবে। পবিত্র মাহে রমজান এ ধরনের একটি সাধনার মাস, যা কোনো পুরোহিত বা যাজক শ্রেণির জন্য সীমাবদ্ধ নয়, ইসলামী সমাজের সর্বস্তরের সব সদস্য এই সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারে।

রুহের খোরাক পাওয়ার সাধনার লক্ষে পবিত্র মাহে রমজানের একটি বিশেষ ইবাদত এতেকাফ। সারা জীবন সংসার জীবন ত্যাগ নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট দিনে ইবাদতে নিমগ্ন থেকে মন ও আত্মাকে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত ও আল্লাহমুখী করার এই সাধনা স্বভাবসম্মত, ঐতিহ্যগত।

হযরত ইবরাহীম (আ.) যখন কাবাঘর নির্মাণ করেন, তখন থেকে এতেকাফের নিয়ম চলে আসছে। নির্ধারিত দিনে বা সময়ে নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান করতে হয়ে ইতিকাফে। এতেকাফ অনেকটা ধর্ণা বা অবস্থান ধর্মঘটের মতো দেখায়। ধর্মঘট হয় কোনো দাবি আদায়ের জন্যে। এতেকাফেও আছে কিছু দাবি, কিছু আবদার ও প্রস্তাবনা। বান্দা সংসারের সব কাজ কর্মের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মসজিদে অবস্থান নেয়। বাস্তব কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করে, হে আল্লাহ! সারা বছর নানা কাজেকর্মে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। মনের মণিকোঠায় তোমার সান্নিধ্যের বাসনা লালন করেছি। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি কয়েকটা দিন দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি বাকরি, সুখময় জীবনের সাথে সম্পর্ক স্থগিত করে একান্ত তোমার হয়ে যাব। আমার জীবনের গুনাহখাতা মাফ করে দাও। আমার প্রতি সদয় হয়। আমার দিলের জমিনকে আগাছামুক্ত কর।

আজে বাজে চিন্তা থেকে আমার মনকে মুক্ত কর। একমাত্র তোমার চিন্তাই আমার মনে স্থায়ী কর। তোমার মহব্বতের চারাগাছ রোপণ করে দাও। আমি জীবনভর তোমার হয়ে থাকার, তোমার আদেশ মান্য করে চলার শপথ গ্রহণ করেছি। সে শপথকে অভ্যাসে পরিণত করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছি। আমার চিন্তায় ধ্যানে মনে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি একান্ত তোমার। আমার জীবন তোমার জন্য সঁপে দিয়েছি। কাজেই আমার মনের আকুতি, তুমি আমার হয়ে যাও। তুমি আমার আমি তোমার। এতেকাফকারীদের ধ্যানে ও মনে অনুরণিত হয়, হওয়া উচিত এই চিন্তা ও চেতনা।

আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য এতেকাফ একটি শক্তিশালী সাধনা। এ কারণে নবী করিম (সা) প্রত্যেক বছর এতেকাফ করেছেন। তিনি বলেন, আমি এক বছর রমজানের প্রথম দশদিন ইতেকাফ করেছি, আবার দ্বিতীয় দশদিন ইতিকাফ করেছি, পরে আমাকে জানানো হয়, শবেকদর, মহিমান্বিত রজনী রমজানের শেষ দশকে। কাজেই তোমরা রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ কর। তাতে কী বুঝা যায়। এতেকাফের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি, আপন ভুবনে আল্লাহকে পাওয়া। কিন্তু এর লক্ষ্য একটি। সেই লক্ষ্য হল, লাইলাতুল কদর লাভ করা। লাইলাতুল কদরে রাত জেগে ইবাদত করা। আল্লাহর সান্নিধ্যের উঞ্চতায় নিজের মন ও দেহকে তাপিত ও জাগ্রত করা। লাইলাতুল কদরের কী অতুলনীয় গুরুত্ব হয়ত মানুষ বুঝবে না। এ রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত বুঝানোর জন্য কোরআন মজিদে একটি শব্দ বা বাক্যই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু না। তার জন্য আলাদা একটি সূরা নাজিল করেছেন মহান রাব্বুল আলামীন, যার নাম সূরা কদর। বলা হয়েছে এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এই একটি রাত, রাতভরের ইবাদত।

‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। আপনি মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে কী জানেন? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সেই রাতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। প্রত্যেক কাজে শান্তিই শান্তি। সেই রজনী ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত বলবৎ থাকে।’ (সূরা কদর)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত