ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই দেশের ভেতরে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করতে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে যাচ্ছে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা। এসব ষড়যন্ত্র রুখতে আওয়ামী লীগের বিচার ও দলটির নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। গতকাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ঢাকা মহানগর এনসিপির বিক্ষোভ সমাবেশে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, যে ভাইয়েরা রাজপথে জীবন দিয়েছেন, তাদের রক্তের শপথ আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।
গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার, নিবন্ধন বাতিল, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, কোনো শান্তিপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিদায় হয়নি। হাজারো মানুষের রাজপথ ভেজানো রক্তের মধ্য দিয়ে এই খুনি-ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিদায় হয়েছে। আমাদের পুনর্জন্ম হতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগকে আমরা পুনর্বাসিত হতে দেব না। বাংলাদেশে যতবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, ততবার সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে উল্লেখ করে আখতার হোসেন বলেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো সাত মাস পেরিয়ে গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কোনো বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলব, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আওয়ামী লীগের নামে কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানো যাবে না। অল্প সময়ের মধ্যে নিবন্ধন বাতিল করতে হবে।
রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশে আওয়ামী লীগের বিচার ও দলটির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বলেন, আমরা আপনাদের কাছ থেকে যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ আশা করেছিলাম, তা এখনও দেখতে পাইনি। আমরা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ চাই না, তবে আওয়ামী লীগ বাংলার জমিনে যে অপরাধ করেছে, যেভাবে মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করেছে, খুন-গুম করেছে, হত্যার রাজনীতি চালিয়েছে, তার প্রকৃত বিচার করা হলে আগামী ৩০০ বছরেও তারা বাংলার মাটিতে ফিরে আসবে না।
তিনি বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যতদিন এনসিপির একজন কর্মীও বেঁচে থাকবে, ততদিন বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে দেয়া হবে না। হাসনাত বলেন, ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়নি। তারা পালাতে বাধ্য হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। বিশ্বের ইতিহাসে কোথাও নেই যে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা পালিয়ে গেছে, তাদের আবার নির্বাচনে ফিরিয়ে আনা হয়।
ভারত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ দেশের নাটাই ছিল ভারতে, ঘুড়ি উড়েছে বাংলাদেশে। আমরা ৫ আগস্টের মাধ্যমে ঘুড়ির সুতা কেটে দিয়েছি। ভারতের আধিপত্যবাদ বাংলাদেশে চলতে দেয়া হবে না। বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা মহানগর শাখার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে তারা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার পর্যন্ত গিয়ে কর্মসূচি সমাপ্ত করেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ ও গণহত্যার বিচারের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর এলাকা কুমিল্লার দেবিদ্বারে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের দেবিদ্বার নিউমার্কেট স্বাধীনতা চত্বরে এসে শেষ হয়। এসময় শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান নাহিদের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, কাজী সাফরিন জোহা, সিয়াম ইসলাম, মো. নাফিস, কাজী নাছির। বিক্ষোভ মিছিলে উপস্থিত ছিলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত সিয়াম মজুমদার, আতিকুল ইসলামসহ দেবিদ্বারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এসময় তাদের স্লোগান দিতে শোনা যায়, ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’, ‘অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কর, করতে হবে, করতে হবে’ ‘ওয়াকার না হাসনাত, হাসনাত হাসনাত’, ‘হাসনাত আবদুল্লাহর কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। বক্তারা বলেন, ছয়-সাত মাস হয়ে গেছে এখনও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু কেউ যদি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায় তাহলে বলব, চূড়ান্ত মুক্তির পথ মৃত্যু। প্রয়োজন হলে আরও আবু সাঈদ শহিদ হবে, তবু আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত হতে দেয়া যাবে না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ হয়ে গেছে। এখন শুধু অফিসিয়াল ঘোষণা বাকি। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করলে জুলাই আন্দোলন আবার হবে। ভারতের প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশে চলবে না। প্রতিটি দলকে আওয়ামী লীগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিষ্কার করতে হবে। আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের সংগঠন ওরিয়র্স অব জুলাই। এর মাঝে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা হলে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল থেকে তারা এই আল্টিমেটাম দেন।
কর্মসূচি অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করলে শহিদ মিনারে জুলাইয়ে শহিদ পরিবারের সদস্য ও আহতরা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। বিক্ষোভ সমাবেশে কর্মসূচি ঘোষণা করে আহতরা বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয় থেকে ঘোষণা অথবা সিদ্ধান্ত আসতে হবে। এই সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিশ্রুতি না এলে ৪৮ ঘণ্টা পর সারা দেশ থেকে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। যতদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা না হবে শহিদ মিনারে তাদের সেই অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
আহতদের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টার দেয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ সব উপদেষ্টার অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। কেউ যদি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে তাহলে তাদের গদি থাকবে না। কোনো রাজনৈতিক দল যদি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে তাদেরও আওয়ামী লীগের মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে।
গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশের আগে সকালে এনসিপির রাজধানীর বাংলামোটর রূপায়ণ সেন্টারে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে ভোটার হওয়ার বয়স ১৬ বছর এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২৩ বছর করার প্রস্তাব দেয়ার কথা জানায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আজ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার সুপারিশমালা জমা দেবে দলটি। সেখানে ওই প্রস্তাব দেবে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, আওয়ামী লীগ দেশবিরোধী শক্তি, রাজনীতিতে ফিরলে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান আর কার্যকর নেই উল্লেখ করে নতুন সংবিধান রচনার দাবি জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির এই নেতা। সারোয়ার বলেন, এনসিপি মনে করে আগামী নির্বাচন গণপরিষদ হওয়া উচিত। সংবিধান সংস্কার কাজ শেষ করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই গণপরিষদই আইন সভায় রূপান্তরিত হবে।