একজন বড় লোক মারা গেছেন। পত্রিকায় তার স্মৃতিচারণ করে শোক প্রকাশ করা হবে। সাধারণত কী লেখা হয়। লেখা হয় তিনি কত বড় শিক্ষিত ছিলেন বা সমাজের জন্য, মানুষের সেবায় কী কী করেছেন তার বর্ণনা। কয়টি স্কুল, মাদ্রাসা বা জনহিতকর কাজ করেছেন, বইপুস্তক লিখেছেন কিনা উল্লেখ করে মূল্যায়ন করা হয়, লোকটি কত মহৎ ছিলেন। লোকটি কয়টি বাড়ি রেখে গেছেন, কত টাকা ব্যাংকে জমা আছে বা তার সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় না। প্রশ্ন হলো, এমন কেন? এর একটাই জবাব, ধন-সম্পদ বাড়ি-গাড়ি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ। এগুলো দিয়ে কারো প্রকৃত মনুষ্যত্ব মাপা হয় না। মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব পরিমাপের মাপকাঠি হল, লোকটি পরের জন্য, সমাজের জন্য, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিংবা সমাজকে আলোকিত করার জন্য কী করেছেন। কয়টা স্কুল, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। জনহিতকর কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
পাখিরা ভোরের হাওয়ায় ডানা মেলে বেরিয়ে যায় খাবারের সন্ধানে। সারা দিনমান ব্যস্ততায় কাটায় পেটের জ্বালা মেটাতে। পেটভরা খাবার পেয়ে কিচির মিছির শব্দে আল্লাহর শোকর গেয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে বাসায়। গবাদিপশুর জীবনও চলে এভাবে চারণভূমিতে। পশুপাখিদের জীবনে নিজের উদর, বড় জোর নিজের বাছুর ছাড়া কারো চিন্তা নেই। মানুষও জীবজগতের বাসিন্দা; তবে অন্য প্রাণিকুল থেকে সে আলাদা।
একব্যক্তি পাক্কা নামাজি, ইবাদত বন্দেগীতে জুড়ি নেই। কিন্তু অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজেই সুফি, থাকেন মসজিদের ধ্যানে। এমন সুফি, পাক্কা নামাজি বড় স্বার্থপর। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সকাল হল, অথচ মুসলমানদের বিষয়াদি নিয়ে উদ্যোগী হল না সে মুসলমান নয়।’ অপর একটি হাদিসের ভাষ্য- ‘যে লোক পরিতৃপ্ত হয়ে খেল অথচ তার প্রতিবেশি ভুখা রাত কাটাল, (ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার দিতে পারল না।) সে লোক মোমিন নয়।’ আমরা যারা রমজানে পাক্কা ইবাদত করছি বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি, তাদের জন্য উপরোক্ত হাদিস দুটিতে মেসেজ আছে।
সমাজে যাদের টাকা-পয়সা বেশি তাদের আমরা বলি বড়লোক। শিক্ষিত ধার্মিক হলে বলি ভালোমানুষ। নিঃসন্দেহে যারা মুত্তাকী পরহেজগার তারাই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত। এই বড়লোক, ভালোমানুষ ও মুত্তাকির পরিচয় দেয়া হয়েছে কোরআন মজিদে। তাদের সঠিক পরিচয়, তারা গরিব অসহায় মানুষের সেবা করে। যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি যত্ন নেয় না, অবজ্ঞা প্রদর্শন করে তাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এর একটি উদাহরণ সূরা মাউন। এই সূরায় পরকাল ও কর্মফল অস্বীকারকারীদের উেেদ্দশ্যে নাজিল হয়েছে বটে; কিন্তু যারা লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, ইবাদত বন্দেগী করে; অথচ সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকদের প্রতি যত্ন নেয় না, তাদেরও সতর্ক করা হয়েছে কঠোর ভাষায়। লক্ষ্য করুন।
১. তুমি কি দেখেছ সেই লোককে যে দ্বীন (পরকাল, কর্মফলকে) অস্বীকার করে? ২. সে তো ঐ লোক যে এতীমকে রূঢ়ভঅবে তাড়িয়ে দেয়, ৩. এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না। ৪. সুতরাং দুর্ভোগ সেই নামাজ আদায়কারীদের ৫. যারা তাদের নামাজের প্রতি উদাসীন, ৬. যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে। ৭. এবং গ্রহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট-খাট সাহায্যদান থেকে বিরত থাকে। (সূরা মাউন, সূরা নং-১০৭)।
পরিষ্কার হলো, সমাজের অভাবগ্রস্তদের প্রতি যত্ন-আত্তিই বড়লোক, ভালোমানুষ এবং পরহেজগার হিসেবে আল্লাহর কাছে সম্মানের আসনে বরিত হওয়ার মানদ-। এ ব্যাপারে চিরাচরিত ধ্যান-ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে, যাতে মনে করা হয় যে, বৈষয়িক সহায় সম্পদ বুঝি সম্মানের মানদ-। আল্লাহ পাক বলেন, ১৫. ‘মানুষের স্বভাব হলো, তার প্রতিপালক যখন তাকে পরীক্ষা করেন, সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেন, তখন সে বলে আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মানিত করেছেন।’
এই চেতনা থেকে নিজেকে বড়লোক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে থাকে। আবার যখন সম্পদ হারিয়ে বসে তখন তার অবস্থা দাঁড়ায়-
১৬. ‘এবং যখন (আল্লাহ) তাকে পরীক্ষা করেন, তার রিজিক সংকেচিত করার মাধ্যমে; তখন সে বলে আমার প্রতিপালক আমাকে হীন করেছেন।’
আল্লাহ পাক পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন যে, সমাজে ও আল্লাহর কাছে সম্মানিত হওয়ার মাপকাঠি কখনো অর্থবিত্ত বা সামাজিক মর্যাদা নয়-
১৭. ‘না কখনো নয়, বরং তোমরা এতিমকে সম্মান করো না। ১৮. এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। ১৯. এবং তোমরা উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পূর্ণরূপে ভক্ষণ করে ফেল। ২০. এবং তোমরা ধন-সম্পদ অতিশয় ভালোবাস।’ -(সূরা ওয়াল ফাজর, আয়াত: ১৫-২০)।
৬. সে বলে আমি প্রচুর অর্থ নিঃশেষ করেছি।’ ১১. সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি। ১২. তুমি কী জান বন্ধুর গিরিপথ কী? ১৩. তা হচ্ছে দাসমুক্তি। ১৪. অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্যদান। ১৫, এয়াতীম আত্মীয়কে ১৬. অথবা দারিদ্র নিষ্পেষিত নিঃস্বকে।
১৭. তদুপরি সে অন্তর্ভূক্ত হয় মুমিনদের এবং তাদের যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয়, ধৈর্য ধারণের ও দয়া-দাক্ষিণ্যের। ১৮. এরাই সৌভাগ্যশালী।’ -(সূরা বলদ, আয়াত-৬ এবং ১১-১৮)।