অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মাথায় সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, জ্বালানি তেল, বিমানের টিকিট ও ইন্টারনেটের দাম কমিয়েছে। একইসঙ্গে চাঁদাবাজি ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কারসাজি দমিয়ে জনগণকে স্বস্তি দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে আগামীতে আরও বহু পণ্যের দাম কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় নেতাদের লাভের আশায় দেশের ভেতরে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে পণ্যের দাম বাড়িয়ে মূল্য ঘোষণা করে চক্রকে সুবিধা দেয়া হয়। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বোঝা তৈরি হয়, যা শিগগিরই নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। এরপরেও ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এসে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন খাতে দাম কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা লাগালে কাছাকাছি রাখতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ আওয়ামী লীগের আমলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ভোক্তারা। এখন মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ায় লাগাম টানার জোর প্রয়াস চালাতে অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ শুরু করেছে। যার প্রভাব এরইমধ্যে বাজারে দেখা গেছে। বিমানের টিকিটের দাম কমার কয়েক দিনের মাথায় ইন্টারনেটের দাম কমেছে। এছাড়াও এবারের রমজানে আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, টমেটো, চিনি, তেল, ডাল ও ছোলাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম কমেছে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বাজারে। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটমুক্ত দেশ গড়িতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বাজার পরিস্থিতি মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের কাছাকাছি থাকায় স্বস্তি ফিরছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, কারওয়ানবাজার, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ী ঘুরে দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের দাম কমায় এসব বাজারের বিক্রেতাদের বছরের শুরুতে বিক্রি বেড়েছে। দাম কমার আভাস পেয়ে পণ্যের গুদামজাত কমিয়ে দেয়। এছাড়াও বিমানের টিকিট দাম কমায় যাত্রীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।
বিমানের টিকিটের দাম কমাতে গত ফেব্রুয়ারিতে ১০টি নির্দেশনা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই নির্দেশনায় মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বিমানের টিকিটের দাম ৭৫ শতাংশ কমানো হয়। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে এয়ার টিকিট নিয়ে ১০ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসীদের টিকিটের দাম নিয়ে সমালোচনার পর এসব নির্দেশনা দেয় সরকারের তরফ থেকে। চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও কিংবা চাহিদার অতিরিক্ত টিকিট মজুদ করে অন্য এজেন্টের মাধ্যমে এয়ার টিকিট বিক্রির ফলে দাম বেড়ে গেলে মূল ট্র্যাভেল এজেন্টের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল করা হবে।
জানা গেছে, সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সরকারের এই নির্দেশনার ফলে এখন ওইসব রুটের টিকিট ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। কিছু এয়ারলাইন্স ঢাকা-দাম্মাম, ঢাকা-রিয়াদ রুটের টিকিট মাত্র ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। সৌদি আরবগামী ফ্লাইটসহ বিভিন্ন গন্তব্যে বিমান ভাড়া ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আটাবের একটি প্রতিনিধিদল সরকারের এই উদ্যোগে স্বস্তি প্রকাশ করেন। আটাবের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ। প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য জানান। সাক্ষাৎকালে আটাব মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ বিমানের যাত্রীদের টিকিটপ্রাপ্তি সহজ ও স্বল্পমূল্যের করতে সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ২০১৭ সালের আইন পরিবর্তন করে এয়ারলাইন্সগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) নামক যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে এই খাতে সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে যাত্রীরা যেমন অধিক মূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তেমনি ভোগান্তিও বাড়ছে।
সম্প্রতি সরকার যাত্রীদের পাসপোর্ট ডিটেইল ছাড়া টিকিট বুকিংয়ের পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা অনিয়ম এবং যাত্রী হয়রানি বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে আটাবের সভাপতি বলেন, এখন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান এই আইনের ব্যত্যয় ঘটাতে না পারে। এসময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে একদিনের বৈঠকে সব সমস্যা শুনে তার সমাধানের পথ খুঁজে বের করে নতুন সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছিল। এখন এই সিদ্ধান্ত যাতে কেউ উপেক্ষা করতে না পারে তার জন্য আমরা কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করছি। ২০১৭ সালের আইনটিকে পরিবর্তনের পক্ষে তার মতামত থাকবে জানিয়ে তিনি আইন ও বিধি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের জন্য আটাবকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে বৈঠক করার পরামর্শ দেন।
সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম কমায় স্বস্তি ফিরেছে যাত্রীদের। যাত্রীরা বলছেন, সৌদিতে প্রচুর বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করেন। ছুটিতে বাংলাদেশে প্রিয়জনের কাছে এলে ফিরতি বিমানের টিকিট ভাড়া বেশি থাকায় কষ্ট হয়ে পড়ে। সে বিষয় লক্ষ্য রেখে অন্তর্বর্তী সরকার সৌদি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম কমিয়ে দেয়ায় প্রবাসীরা আনন্দিত।
গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির সব ধরনের ইন্টারনেটের দাম কমছে ১০ শতাংশ। গত শনিবার কোম্পানির বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ফলে মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সার্ভিস দুই ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর খরচ কমবে।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ইন্টারনেটের দাম কমানোর জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ যেন সাশ্রয়ে ইন্টারনেট পায় সেজন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাইকারি পর্যায়ে মূল্য কমানো তার মধ্যে অন্যতম। এ সিদ্ধান্তের ফলে ইন্টারনেটের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে লেভেলে সব ব্যান্ডউইথের জন্য দাম ১০ শতাংশ কমবে। এছাড়া ব্যাকবন পর্যায়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ডিডব্লিউডিএম সুবিধা দেয়ার কথা হচ্ছে। যার ফলে ট্রান্সমিশন বাবদ টেলিকম কোম্পানিগুলোর খরচ ৩৯ শতাংশ কমবে, যোগ করেন আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে টেলিকম অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অপারেটররা ভোক্তা পর্যায়ে ইন্টারনেটের মূল্য ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-উই ৬ এর সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।
সেপ্টেম্বরের জন্য নতুন জ্বালানি তেলের দাম ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা। পেট্রলের নতুন দাম প্রতি লিটার ১২৭ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২১ টাকা ও অকটেনের দাম ১৩১ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২৫ টাকা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিজের ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখতে হলে নানামুখী চাপ সত্ত্বেও আরো কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করে সুদের হার বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে বাজারে অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ কমে। কারণ ডিসেম্বরে নির্বাচন হলেও দেশে নিশ্চিতভাবেই টাকার প্রবাহ বাড়বে। এজন্য সবার আগে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে আমদানি শুল্ক হ্রাস ও মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে হবে।