মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন তামিম ইকবাল

* শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন প্রধান উপদেষ্টা * দোয়া চাইলেন তাসকিন-মিরাজরা

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ক্রীড়া প্রতিবেদক

আচমকা এক খবরে হঠাৎ বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। লাল সবুজের ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে দেখা দিয়েছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সবাই চোখ রেখেছিলেন অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও টেলিভিশনের পর্দায়। তাদের একটাই জিজ্ঞাসা তামিম ইকবালের কি খবর। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে টাইগার সমর্থকদের মধ্যে। হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া তামিমের জ্ঞান ফিরেছে। তিনি পরিবারের সদস্য ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথাও বলছেন। বিসিবির প্রধান চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী জানান কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে আগামী ৪৮ ঘণ্টা চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকবেন তামিম। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন দেবাশীষ। তামিমের সঙ্গে দেখা করতে তার পরিবারের সদস্য ও সতীর্থরা হাসপাতালে এসেছেন। বিকেএসপিতে ম্যাচ খেলে হাসপাতালে এসেছেন তার দীর্ঘ সময়ের সতীর্থ মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ ও স্পিনার তাইজুল ইসলাম।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অসুস্থ তামিম ইকবালের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে কথা বলেছেন। নিজাম উদ্দিন তামিম ইকবালের স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করবেন।

গতকাল সোমবার বিকেএসপির ৩ নম্বর মাঠে চলছিল ডিপিএলের অষ্টম রাউন্ডের ম্যাচ। শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে খেলতে নেমে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তামিম ইকবাল। পরে জানা যায়, অল্প সময়ের মধ্যেই দুইবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক। জরুরি অবস্থায় তাকে নিকটস্থ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালে নেয়ার পর হার্টে রিং পরানো হয়েছে। তবে তামিমের জটিলতা এখনো কাটেনি বলে জানা গেছে। ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতালের মেডিকেল পরিচালক ড. রাজিব সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যতগুলো চিকিৎসা প্রয়োজন, সবকিছু করা হয়েছে। আল্লাহর রহমতে কন্ডিশনটা অনুকূলে আছে। ওনার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এটার জন্য একটা এনজিওগ্রাম, এনজিওপ্লাস্টি এবং স্টেন্ট করা হয়েছে। এটা খুব স্মুথলি এবং এফিশিয়েন্টলি হয়েছে। ওনার এই ব্লকটা পুরোপুরি চলে গেছে এখন।’

সকাল থেকেই দেখেছেন তামিমের অসুস্থতা ও পরবর্তী চিকিৎসা কার্যক্রমের পুরোটা দেখেছেন ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল। দুপুরে গণমাধ্যমকে তিনি জানান নিজের অভিজ্ঞতা, ‘আমরা যারা কাছ থেকে দেখেছি, আজকের ব্যাপারটা কিন্তু অকল্পনীয়। ক্রিকেটারদের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি, নিজে ক্রিকেট খেলেছি, কিন্তু আজকের মতো এরকম ঘটনা আমার পুরো ক্যারিয়ারে ঘটেনি। সকালে টস করলাম। দুই দলের অধিনায়ক তামিম আসলো, রাফসান (রায়ান রাফসান রহমান) আসলো। টস করে সাধারণত অধিনায়করা চলে যায়। তবে গতকাল আমাদের একটি মিটিং ছিল, সেই প্রেক্ষিতে আমরা প্রায় তিন-চার মিনিট কথা বলি। এরপর ও ড্রেসিং রুমে চলে যায়, আমি আমার দায়িত্বে ফিরি। ম্যাচও শুরু হয়ে যায়। ম্যাচ শুরুর প্রায় আধা ঘণ্টা বা ৪০ মিনিট পর এনাম (মোহামেডানের ফিজিও) আমাকে ফোন করে বলে, ‘তামিম বুকে ব্যথা অনুভব করছে।

আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই।’ মাঠে অ্যাম্বুলেন্স ছিল, তামিমের ব্যক্তিগত গাড়িও ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তামিম গাড়িতে উঠে হাসপাতালে চলে যায়। আমিও তাকে সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলাম। তো ও হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম। ও বলছিল, ‘সবকিছু ভালো আছে।’ সেখানে ডাক্তাররা তার ইসিজি করান এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন। ট্রিটমেন্টের পর ডাক্তাররা তাকে বলেছিল সেখানে কিছু সময় থাকার জন্য। তবে তামিম নিজেই বলছিল, সে ঢাকায় ফিরতে চায়।

ঢাকায় ফেরার পরিকল্পনা যখন হয়, তখন সে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করতে বলে। তখন আমি ছিলাম মাঠে। তামিমের সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়া বিকেএসপির ডাক্তার ও ডালিমের (ট্রেনার) সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছিল। আমাকে মোহামেডানের ম্যানেজার শিপন ভাই (সাজ্জাদ আহমেদ শিপন) জানান, হেলিকপ্টার আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম বিকেএসপির এক নম্বর মাঠের দিকে। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার পর (তামিমকে বহনকারী) অ্যাম্বুলেন্স গেল, পেছনে আমার গাড়ি ছিল। তখন কোনো কথা বলা তো দূরের ব্যাপার, তামিমের জ্ঞানও ছিল না। একেবারে অচেতন অবস্থা। আমরা খুব ভড়কে যাই যে, হেলিকপ্টারে তুলব নাকি গাড়িতেই রাখব। তখনকার দৃশ্যটা এরকম, ডালিম ওর বুকে চাপ দিচ্ছিল, ওর মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছিল, পালস (নাড়ির স্পন্দন) নেই।

কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, সেটা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে যেতে অনেক সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে তামিম ট্রিটমেন্ট মিস করবে। গুরুতর কিছু হয়ে যেতে পারে। বরং এই কেপিজি হাসপাতালে ফেরত নিয়ে যাওয়া উচিত। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাদের। আমরা এখানে চলে আসি। আসার পথে কোনো জ্যাম ছিল না রাস্তায়। একইসঙ্গে ডাক্তার ও ডালিম তামিমের বুকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুই হচ্ছিল না। পৌঁছানোর এক মিনিট আগে আমাকে বলা হলো, একটু মনে হয় রেস্পন্স পাওয়া যাচ্ছে।

আমাদের পুরো মনোযোগ তখন কত দ্রুত আমরা হাসপাতালে আসব সেটার দিকে। ড্রাইভারের সহায়তায় আমরা চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখানে পৌঁছে গেছি। এর মধ্যেই আমি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতিকে (ফারুক আহমেদ) বিষয়টা জানাই। আর যেহেতু আমি ম্যাচ রেফারি, তাই সিইওর (নিজামউদ্দিন চৌধুরী) সঙ্গেও কথা বলি। তাকে বলি, হাসপাতালে যোগাযোগ করার জন্য, যাতে আমরা এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রিটমেন্ট পাই।

সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর সমন্বয় করে দিয়েছেন। আসার পর দেখি, এখানে ডাক্তারদের একটি দল তৈরি। তামিমকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো, চিকিৎসা দেওয়া হলো। সম্ভবত তাকে লাইফ সাপোর্টেও নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে ক্যাথ ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি তো শুরু থেকে ছিলাম, ডাক্তাররা সবকিছু দ্রুততার সঙ্গে করেছেন খুব ভালোভাবে।

এনজিওগ্রাম করানোর সময় তামিমের পক্ষ থেকে একজনকে যে স্বাক্ষর করতে হয়েছে, সেটা আমিই করেছি। এর মধ্যে আমি নাফিসের (তামিমের ভাই নাফিস ইকবাল), আকরাম ভাইয়ের (তামিমের চাচা আকরাম খান) ও ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, আমাকে স্বাক্ষর করতে। বিসিবি চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীর সঙ্গে এই হাসপাতালের ডাক্তাররা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন, জানিয়েছেন তামিমকে কী ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। এই সার্বিক সমন্বয় ও মুহূর্তের মধ্যে যথাযথ সিদ্ধান্ত মিলিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও আমাদের সবার সহযোগিতায় তামিম এখন পর্যন্ত বর্তমান অবস্থায় আছে।’

তামিক ইকবাল হার্ট অ্যাটাকের খবরে সতীর্থদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ, মাথায় শুধুই তামিমকে নিয়ে ভাবনা। স্রষ্টার কাছে করেই চলেছেন প্রার্থনা। তামিমের জন্য দোয়া চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন পেসার তাসকিন আহমেদ ও অলরাউন্ডার মেহেদী হাসান মিরাজ। দুজনই তাদের ‘তামিম ভাইয়ের’ দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। তাসকিন লিখেছেন, ‘তামিম ইকবাল ভাই, সাভারের বিকেএসপিতে একটি ম্যাচ চলাকালীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তিনি এখন লাইফ সাপোর্টে। এই কঠিন সময়ে সবাই দোয়ায় রাখবেন। আল্লাহ তাকে দ্রুত সুস্থতা দান করুন।’

মিরাজ লিখেছেন, ‘তামিম ভাইয়ের, আপনার দ্রুত সুস্থ হয়ে ফেরার প্রত্যাশা করি। দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য আমাদের ভাবনা ও দোয়া আপনার সাথে আছে।’ লিটন দাস লিখেছেন, ‘তামিম ভাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। আমাদের প্রার্থনা আপনার সঙ্গে আছে।’ এদিকে তামিমের অসুস্থতার খবরে আজ বিসিবির পরিচালকদের সভা স্থগিত করা হয়েছে।