বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের মধ্যদিয়ে। আজ প্রধান উপদেষ্টা চার দিনের চীন সফরে বেশকিছু ঘোষণা আসতে পারে বলে বাংলাদেশ সরকার ও চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লালগালিচায় বরণ করতে অপেক্ষায় রয়েছে বেইজিং।
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা চীনে তার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পাশাপাশি ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে চারটি আলাদা বৈঠক হবে। ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে শীর্ষ বৈঠকের পাশাপাশি দেশটির শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করবেন। আজকে দুপুরে চীনের পাঠানো চার্টার ফ্লাইটে হাইনান প্রদেশে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। ২৭ মার্চ হাইনানে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার ২৫ দেশের জোট বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। এরপর সেখান থেকে বেইজিং যাবেন প্রধান উপদেষ্টা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা নতুন একটি ফাউন্ডেশন গড়ে যেতে চাই। আর এর উপর ভিত্তি করেই আগামীদিনে পথ চলবে দুই দেশ।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আশা করছি এই সফর দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বিনিয়োগ বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের এই সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে চীন সহযোগিতা করতে চেয়েছে। একইসঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জন্য তিস্তা প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা প্রকল্পে পানি ব্যবস্থাপনা, সামরিক সহযোগিতা, শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য চীন এগিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হলেও অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতায় অগ্রাধিকার থাকবে। আর চীনের দিক থেকে জোর থাকবে সামগ্রিক রাজনৈতিক সহযোগিতায়। রাজনৈতিক সহযোগিতার কেন্দ্রে থাকবে এক চীন নীতি এবং প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশের যুক্ততা। বাংলাদেশ আর্থিক ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থায়নের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেও চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে দুই দেশের সম্পর্কের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রাধান্য দিতে চায় না। চীন বলছে, আর্থিক সহযোগিতা সম্পর্কের একটি অংশ। ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে পরবর্তী ধাপে উন্নতির স্বার্থে সহযোগিতাকে রাজনৈতিক পরিসরে দেখাটা বাঞ্ছনীয় এবং সেটাই বাস্তবসম্মত। ২৮ তারিখে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করবেন। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা শেষে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের পাশাপাশি সহযোগিতার কয়েকটি বিষয়ে ঘোষণা আসার কথা রয়েছে। বৈঠকের পর একই দিনে তিনি চীনের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী সংলাপে যোগ দেবেন। এরপর আলাদা তিনটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেবেন। এই বৈঠকের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, উৎপাদন ও নতুন সম্ভাবনার বিকাশ, সামাজিক ব্যবসা ও তরুণ উদ্যোক্তা এবং টেকসই অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগবিষয়ক ওই চারটি আলোচনা ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা চীনের শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াহুইয়ের দপ্তর পরিদর্শনে যাবেন। চীন সফরের শেষ দিনে অর্থাৎ ২৯ মার্চ তিনি পিকিং ইউনিভার্সিটিতে একটি বক্তৃতা দেবেন। ওই দিন বিকালে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তির বছরে এই সফরটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সম্প্রতি চীনের চারটি বিশেষায়িত হাসপাতাল বাংলাদেশের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে সহযোগিতায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উত্তরণের পথ সুগম হবে বলে আমরা আশা করছি।’
ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে, চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাইওয়ান চীনের অংশ। চীনের মূল স্বার্থসম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন করে। একই সঙ্গে চীনের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করে বাংলাদেশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব পেতে পারে অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভূরাজনীতিসহ সামগ্রিক নানা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিল্পকারখানা স্থানান্তর, আকাশপথে সংযুক্তি, অতীতে ঘোষিত প্রকল্পগুলোতে অর্থ ছাড় ত্বরান্বিত করার বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার থাকতে পারে। সেই সঙ্গে থাকবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি। সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সফরে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা, মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা, দুর্যোগ প্রশমনে সহায়তা, চীনা গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চীনের চিরায়ত সাহিত্য অনুবাদ ও প্রকাশ, ক্রীড়াক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার মধ্যে সহায়তাসহ বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।