ঢাকা রোববার, ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালেমায় লেখা স্বাধীনতার মর্মবাণী

কালেমায় লেখা স্বাধীনতার মর্মবাণী

জন্মের পর থেকে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি, হামাগুড়ি, হাঁটি হাঁটি পা পা করে দৌড়ঝাঁপ দিয়ে শুরু হয় জীবন তরঙ্গ। এসব কিছুর মূলে থাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানো ও স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা। আজন্ম স্বাধীনচেতা হলেও মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। সে দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে পারে, কিন্তু এক পায়ে হাঁটার স্বাধীনতা তার নেই। বাস্তব জীবনে অনেক কিছুতে অনেকের সাহায্য নিয়ে চলতে হয়। তখনই তার উপরে আপতিত হয় অনেক কিছুর চাপ, লোভের আকর্ষণ, অন্যের প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। এখানেই তাকে নির্ণয় করতে হবে, অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতার মাত্রা। নচেৎ বিভিন্ন ব্যক্তি, শক্তি, বা অলীক চিন্তা তার স্বাধীন চেতনাকে হাইজ্যাক করবে। নানা দিকের আকর্ষণে দিশেহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাবে। চোখে অন্ধকার দেখবে।

জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার হতাশায়, না পাওয়ার ব্যর্থতায়, অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে, আমি কেন পিছিয়ে’ এই চিন্তায় খেই হারিয়ে ফেলবে। এ ধরনের মানসিক অস্থিরতা থেকে নিস্তার দিতে পারে বিশ্বাস। প্রথমে নিজের উপর বিশ্বাস। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হওয়া ছাড়া কেউ বিশ্বাসভ্যতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।

আত্মবিশ্বাসের প্রথম শর্ত নিজের সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস। তিনি একাধারে সৃষ্টিকর্তা, জীবনাজীবিকার ব্যবস্থাপক, লালন-পালনকর্তা, জীবনের সবকিছুর নিয়ামক। আমি তাকে বিশ্বাস করি, যারা সৎপথে চলে তাদের তিনি সাহায্যকারী। সুখে দুখে মানুষের কান্ডারী, আমাকেও সাহায্য করছেন- এই বিশ্বাস থেকে জাগ্রত হয় আত্মবিশ্বাস। আল্লাহর পথে থাকলে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমাকে বিপথগামী করতে পারবে না- এধরনের আত্মবিশ্বাস না থাকলে মানুষ জীবনে হতাশায় ভোগে। মানসিক স্বস্তির জন্য মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নেয়। কখনো ব্যর্থ হয়ে আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়।

কথাগুলো খুবই সুন্দর এবং পরিমার্জিত ভাষায় আল্লাহতায়ালা ব্যক্ত করেছেন কোরআনুল কারিমে- ‘আল্লাহ ওইসব লোকদের অভিভাবক, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এই ঈমানের বলে আল্লাহতায়ালা তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আনেন নূরের দিকে। আলোর জগতের পথ খুলে দেন। চোখে অন্ধকারের পরিবর্তে নূরের ঝলকানি আসে’। (সূরা বাকারা: আয়াত-২৫৭)।

জীবন যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে হতাশার গ্লানির পরিবর্তে আশার আলোকমালা দ্যুতি ছড়ায়। আর যারা কাফের, আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে শুধুই হাবুডুবু খায়। আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসের কারণে তাগুত এসে তাদের অভিভাবক হয়ে যায়। তাগুত মানে খোদাদ্রোহী, সেটা মানুষ থেকে বা জিন থেকে হোক। যারাই মানুষকে সৎপথ চলতে বা আল্লাহর পথ অনুসরণ করতে বাধা দেয় তারাই তাগুত। যারা কাফের তাদের জীবনে তাগুত এসে অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে। তাগুত তাদের আলোর পথ থেকে বের করে অন্ধকার জগতে নিয়ে যায়। এদের পরিণাম হবে জাহান্নাম। জাহান্নামের লেলিহান আগুনই তাদের শাস্তি।

ধর্মতাত্ত্বিকরা বলেন, মানুষ সৎ কাজ করুক, অসৎকাজ করুক, তার একটা ছাপ মানুষের মূল সত্তায় সঞ্চিত হয়। আমরা কম্পিউটারে যা কিছু লিখি অদৃশ্য মেমোরিতে, হার্ডডিস্কে, তা সংরক্ষিত হয়। প্রিন্ট দিলে কাগজে ছাপা আকারে বেরিয়ে আসে, দেখা যায়। মানুষের ভালো-মন্দ কাজের নিষিক্ত, নির্যাসও মান সত্তার হার্ডডিস্কে জমা হয়। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী, এ বিশ্বাস তাদের সৎপথে পরিচালিত করে। সুন্দর, কল্যাণকর, ভালো কাজ সম্পাদন করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর বিপরীতে আছে কুফরি তথা আল্লাহর নাফরমানি। কাফেরদের সামনে অসৎ, অসুন্দর, ভ্রান্তির পথ খুলে যায়। তখন মন্দগুলো তার হৃদয়পটে সঞ্চিত হয়।

কাফেররা কোথায় থেকে এলাম, কোথায় ছিলাম, কোথায় যেতে হবে। জীবনের শেষ গন্তব্য কি হবে- এসবের হিসাব মিলাতে পারে না। ফলে, অন্ধকার ছেয়ে যায় তার মন ও জীবনে। মৃত্যুর পরের কোনো সুন্দর চিত্র ও স্বপ্ন তাদের হাতছানি দেয় না। এসব থেকে সৃষ্ট মনের অস্থিরতাগুলো আগুনের স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয় জাহান্নামে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- জাহান্নামের ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর। (সুরা বাকারা-২৪) পৃথিবীতে মানুষের কৃত গোনাহের নির্যাসগুলো তার ভেতর থেকে আগুনের রূপ নিয়ে জ্বলতে থাকবে। বস্তুত দুনিয়ার জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের দহন জলন ও পরকালের আগুনের লেলিহান থেকে বাঁচতে হলে একজন অভিভাবক চাই, যিনি মানব জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তার সঠিক পরিচয়ে তিনি হলেন আল্লাহ।

আল্লাহকে জীবনে ধারণ করতে হলে সুদৃঢ় বিশ্বাসে বলীয়ান হতে হবে। এই বিশ্বাসের অনুশীলনের জন্য ইসলাম নির্দেশ করেছে বিভিন্ন সাধনা ও কসরত। নামাজের অনেক ফায়দা থাকলেও মূল শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমানকে বদ্ধমূল করা।

রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার অনুশীলন ছাড়া আর কিছু নয়। এসব সাধনা অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে মোমিন জীবনে ফুটে ওঠে ইসলামের মূলমন্ত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর তাৎপর্য।

আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আমি কারো অধীনে নই। কারো পরাধীনতা মানি না। কারো প্রভুত্ব আমি স্বীকার করি না, আল্লাহ ছাড়া। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। তাকে অনুসরণ করেই আমি জীবন পারিচালনা করি। তার আদর্শই আমার পরিচালনার নির্দেশিকা। এটাই ইসলামের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত