ঈদুল ফিতরে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রেমিট্যান্সের ইতিবাচক প্রবাহে রাজধানী ও গ্রামাঞ্চলে কেনাকাটার ধুম লেগেছে। বড় বড় শপিং মল থেকে শুরু করে ফুটপাত, ছোট মার্কেট এবং জুতা বেচার ধুম লেগেছে। এতে ঝিমিয়েপড়া অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমপি, মন্ত্রী, আমলা ও ব্যবসায়ীসহ অনেকে দেশের অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করে। এতে দেশের অর্থনীতি খাতে ধস নামে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূলস্ফীতি বেড়ে যায়। তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালানোর সময়ে দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। যার কারণে দেশের ব্যাংক খাত সোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। সেই জায়গা থেকে ব্যাংক ও অর্থনীতির বিভিন্ন খাত চাঙ্গা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই অর্থনীতির চাকা চাঙা করতে ঈদুল ফিতরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ঈদের অর্থনীতি নিয়ে সরকারিভাবে এখনও কোনো গবেষণা না হলেও বেসরকারি গবেষণা অনুসারে ঈদ ও বৈশাখি উৎসব ঘিরে অর্থনীতিতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হবে। শহর ও গ্রামের অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। এটি ইতিবাচক দিক।
জানা গেছে, ঈদুল ফিতর ও বৈশাখে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় কাপড় কেনাকাটায়। সব শ্রেণির মানুষ নিজের সাধ্যমতো কাপড় কেনাকাটা করে। তাই ঈদ ও বৈশাখি অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে পোশাক খাত। উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীরা ঈদকে কেন্দ্র করে বোনাস পাচ্ছেন। পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা, ভ্রমণ ও বিনোদনে ঈদ অর্থনীতি যোগ হচ্ছে। অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রত্যেক বছরের মতো এবারও ঈদুল ফিতরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ঈদের কেনাকাটার জন্য প্রবাসীরা তাদের স্বজনদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ পাঠিয়েছেন। চলতি মার্চ মাসের ২৪ দিনে ২.৭০ বিলিয়ন (২৭০ কোটি ডলার) ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ৩২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিদিন আসছে প্রায় ১১.২৫ কোটি ডলার বা ১৩৭২ কোটি টাকা করে। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রবাসী আয়ের ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে চলতি মাস মার্চে। অর্থাৎ তিন বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করবে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়, যা রেমিট্যান্স আসায় দেশে নতুন রেকর্ড গড়বে। এর আগে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স (প্রায় ২৬৪ কোটি ডলার) আসে গত ডিসেম্বরে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে গত মাস ফেব্রুয়ারিতে (প্রায় ২৫৩ কোটি ডলার)। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নতুন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বেড়ে যায় প্রবাসী আয়ের গতি। একই সঙ্গে কমেছে হুন্ডি ও অর্থপাচার। আবার খোলা বাজারের মতোই ব্যাংকে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এছাড়া ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বেড়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৮ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৮৪৯ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে আসে এক হাজার ৪৯৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। সে হিসাবে গত অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৫৫ কোটি ডলার। এর আগে গত ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আসে দেশে। আর এ নিয়ে অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্ট থেকে টানা ৭ মাস দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে এসেছে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নভেম্বর মাসে এসেছে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
একক মাস হিসাবে আগে কখনওই এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। এর আগে করোনাকালে ২০২০ সালের জুলাই ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। সেই রেকর্ড ভাঙে ২০২৪ সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে। ২০২৪ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরের পুরো সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২৬৪ কোটি ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এসেছিল ১৯৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুলাই মাস বাদে বাকি ১১ মাসই দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।
অর্থনীতিবিদরা জানান, রেমিট্যান্সের পাশাপাশি ঈদকে ঘিরে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস এবং জাকাত-ফিতরার একটি বড় অংশ অর্থনীতিতে যোগ হয়। রোজার শুরু থেকেই গ্রামের হাট-বাজার থেকে শুরু করে সকল স্তরে টাকার প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। এবার ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকায় চাকরিজীবীরা ছুটি কাটাতে ভোগব্যয়ের পরিমাণও অনেক বাড়বে। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে। ঈদ উৎসব পালন করতে রোজার শেষ দিকে শহরের অধিকাংশ মানুষ যান গ্রামের বাড়িতে। ফলে যোগাযোগ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রত্যাশা করছেন ঈদুল ফিতরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি কাপড় কেনাকাটা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিত্যপণ্যের বাজার। ধনী মানুষের দেয়া জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে প্রায় ৩৮-৪০ হাজার কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অতিরিক্ত বাণিজ্য ১ হাজার কোটি টাকা। ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪-৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিক ঈদ বোনাস পাবেন, যা ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এবারের ঈদবাজার সবমিলিয়ে খুব ভালো কাটবে এবং ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।
ঈদ অর্থনীতি নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঈদকে সামনে রেখে প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরেও দেশের জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। ব্যাংকগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিও গতিশীল হয় ঈদকে ঘিরে। কারণ প্রবাসীরা দেশে থাকা পরিবার-পরিজনের জন্য প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠান। সবমিলিয়ে ঈদকে ঘিরে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরে।