চীনের হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মলেন প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের সংস্কারের বিষয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে অসাধারণ সংকল্প ও শক্তি প্রদর্শন করেছে। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। গতকাল বৃহস্পতিবার চীনে বিএফএ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
চলমান সংস্কার কর্মসূচির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে যাতে নির্বাচনিব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সংস্কার আনা যায়। এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে আমাদের জাতির একটি মৌলিক রূপান্তর সাধিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে যাচ্ছি, তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আমরাও একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘ্নতা বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সুদের হার বৃদ্ধি ও ঋণ পরিষেবা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এশিয়ার ঋণ সংকট আরও গভীর হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বিশ্বব্যাপী ২০৩০ এজেন্ডার প্রতি প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অগ্রগতি খুব ধীর গতিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ শতাংশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হয়েছে। উন্নয়নশীল এশীয় দেশগুলো প্রতি বছর ২.৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এসডিজি অর্থায়নের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসডিজি অর্থায়নের বাইরেও এশিয়াকে ব্যাপক পরিমাণে অবকাঠামো বিনিয়োগ ও দায়িত্বশীল অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনতে হবে।
দুর্নীতি ও আর্থিক অপচয় রোধের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থপ্রবাহের শিকার। এই ধরনের দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি বছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে যে অর্থ পায় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্পদ পুনরুদ্ধার ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য একটি বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো কঠিন সময় পার করছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংকটকে আরও গভীরতর করছে। ‘খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত জ্বালানি আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ঋণ সংকট বৃদ্ধি পায়। আমাদের অবশ্যই টেকসই জ্বালানি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা মানবসম্পদ উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করে, তারা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার দিক থেকে ভালো ফল পায়। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে ডিজিটাল শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটাতে হবে।
তিনি বলেন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন তীব্রতর হচ্ছে, ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠছে এবং মানবিক সংকট বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে, এবং বিশ্ব এখন সম্মিলিত পদক্ষেপের অভাবের কারণে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৫৫ শতাংশ বিশ্ব জিডিপি ধারণকারী এশিয়া এই পরিবর্তনগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। নতুন নিয়ম, বিধিনিষেধ এবং প্রযুক্তি সরকার পরিচালনা ও অর্থনৈতিক নীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এক দশক আগে যে নীতিগুলো কার্যকর ছিল, সেগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
সমৃদ্ধ এশিয়া গড়তে সুস্পষ্ট রোডম্যাপের আহ্বান : বিএফএ সম্মেলনে এশীয় দেশগুলোকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও যৌথ সমৃদ্ধির জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপের আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে এশীয় দেশগুলোর ভাগ্য পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। আমাদের অবশ্যই একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে যা অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং যৌথ সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। এশিয়াকে অবশ্যই একটি টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবি) ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোর এ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেয়া উচিত। আমাদের এমন নির্ভরযোগ্য তহবিল দরকার যা আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করবে।
বাণিজ্য সহযোগিতা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এশিয়া এখনও বিশ্বের অন্যতম কম সংযুক্ত অঞ্চল। এই দুর্বল সংযুক্তি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের অবশ্যই বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য দ্রুত কাজ করতে হবে। এশীয় দেশগুলোকে অবশ্যই সম্পদণ্ডসাশ্রয়ী কৃষিকে উৎসাহিত এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। টেকসই প্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি সমাধান ও জলবায়ু-বান্ধব চাষাবাদের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়াকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যা পুনর্গঠনমূলক, সমবণ্টনমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন : নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে এশীয় নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মিয়ানমারের নাগরিক। আমরা বিপুল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যয় বহন করে চলেছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি সংহতির নিদর্শনস্বরূপ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। যদিও বৈশ্বিক প্রচেষ্টা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তবে তা চলমান রয়েছে। এশিয়ার নেতাদের অবশ্যই একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব সংকটের ওপর আলোকপাত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বর্তমান বিশ্ব বহুমুখী সংকটে ভুগছে, যেখানে যুদ্ধ ও সংঘাত মানবাধিকারের ক্ষতি এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা চলমান থাকলেও গাজায় গণহত্যা এখনও চলছে। ফিলিস্তিন সংকট শুধু আরব বা মুসলিমদের বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক সমস্যা। ইউক্রেন সংকটের দীর্ঘায়িত উত্তেজনা বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বান কি-মুন ও কু ডংগিউয়ের সাক্ষাৎ : গতকাল বৃহস্পতিবার বিএফএ’র বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার চেয়ারম্যান বান কি-মুনের সাক্ষাৎ হয়। এছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর মহাপরিচালক কু ডংগিউও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর আগে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনের ফাঁকে চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীকে ড. ইউনূস: বিএফএ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই ওভারচুক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জ্বালানি সহযোগিতা এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। সম্পর্ক জোরদারে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী। আলেক্সেই ওভারচুক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং জ্বালানি, কৃষি, এবং অবকাঠামো খাতে রাশিয়ার বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। উভয় নেতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে এবং নতুন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন: চলতি বছরের শেষের দিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি ওভারচুক বিষয়টি জানানো হয়। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আর্থিক সমস্যা সমাধান করা হয়েছে, বাংলাদেশ ঢাকার একটি অ্যাকাউন্টে অর্থ পরিশোধ করেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে আরও গম এবং সার আমদানি করবে। রাশিয়ার জ্বালানি জায়ান্ট গ্যাজপ্রম দেশে আরও সমুদ্র ও সমুদ্র উপকূলীয় অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে আগ্রহী। আলেক্সি ওভারচুক দুই দেশের মধ্যে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে বলেন, রাশিয়া আরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে দেশে অধ্যয়নরত দেখতে চায়। তিনি বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশে আরও গম এবং সার রপ্তানি করতে চায়।
বাড়ছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা: ড. ইউনূস বলেন, বহুপাক্ষিকতার অধীনে বৈশ্বিক শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বাড়ছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা। জলবায়ু পরিবর্তন বেড়েই চলেছে। ঋণের বোঝা অসহনীয়। বাড়ছে মানবিক সংকট। উন্নয়ন সহযোগিতায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশ্ব সম্মিলিত পদক্ষেপ একটি উদ্বেগজনক ঘাটতির মুখোমুখি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা এর আগে কখনও এতটা চাপের ছিল না। ২০০৭ সালে আমি বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়াতে ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে আলোচনা করি। আজ আমি ভিন্ন এক ভঙ্গিতে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি, এমন একটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, যে বাংলাদেশ গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঐতিহাসিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। জুলুম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখেছে বিশ্ববাসী।
তিনি বলেন, আমাদের তরুণ সমাজ ও নাগরিকরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে নির্ধারণে ব্যতিক্রমী সংকল্প ও শক্তি দেখিয়েছে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। নির্বাচনি ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংস্কারের জন্য স্বাধীন কমিশন চালু করা হয়েছে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে তা আমাদের জাতির মৌলিক রূপান্তর নিয়ে আসবে।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে বহু চ্যালেঞ্জ: নতুন বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে আমরা বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশও অভিন্ন করে নিয়েছে মন্তব্য করে ড. ইউনুস বলেন, বিশেষ করে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং বাণিজ্য বিঘ্ন অস্থিরতা তৈরি করে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং ঋণ পরিশোধের ব্যয় এশিয়ার ঋণ সংকটকে আরও গভীর করছে। ২০৩০ সালের এজেন্ডায় বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অগ্রগতি ধীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৪ শতাংশ পূরণ হয়েছে। উন্নয়নশীল এশিয়ার দেশগুলো বছরে ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের এসডিজি অর্থায়ন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এসডিজি অর্থায়নের বাইরেও অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণে এশিয়ার বড় আকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ দুর্নীতি ও অবৈধ আর্থিক প্রবাহের শিকার হয়েছে। এই দুর্নীতির চর্চার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বার্ষিক আনুমানিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়, যা তাদের প্রাপ্ত মোট ওডিএর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এশিয়ার ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। সম্মেলনে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার মহাসচিব ঝাং জুন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের চেয়ারম্যান বান কি-মুন এবং চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী ডিং জুয়েশিয়াং বক্তব্য রাখেন।