ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদে সওয়াবের বাজার

ঈদে সওয়াবের বাজার

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর সহবাসে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসুল! সহবাসের মাধ্যমে নিজেদের যৌন ক্ষুধা মিটানো হয়, তাতেও সওয়াব পাওয়া যাবে? রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, যদি যৌন ক্ষুধা হারাম পন্থায় পূরণ করতে তখন কি গুনাহ হত না? অতএব হালাল জায়গায় পূরণ করলে সওয়াব পাওয়া যাবে না কেন? (মুসলিমের বরাতে মিশকাত শরিফ-২/১৬৮ পৃষ্ঠা)।

ইসলাম মানবজাতির জন্য যে সুন্দর জীবনচিত্র এঁকেছে তার একটি ক্যানভাস উপরোক্ত হাদিস। ইসলামে পরম সুখ আনন্দ, চরম ভোগের মুহূর্ত বলতে যা বুঝায় তার মধ্যেও সওয়াবের অনুষঙ্গ আছে। মানুষের মনগড়া ধর্ম বা আদর্শগুলো আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সুখ ও ভোগকে বর্জন করার শর্ত দিয়েছে, যেমন- জীবনভর বিয়ে করতে পারবে না। খ্রিস্টান সমাজে পাদ্রীদের জন্য বিয়ে করা বৈধ নয়। বৌদ্ধ ধর্মেও ভিক্ষু হতে গেলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে না। হিন্দু সমাজেও সংসারজীবন ত্যাগ করে বৈরাগী হতে হবে। কিন্তু ইসলামের সৌন্দর্য হল, ইসলামে বৈরাগ্য নেই। যে ব্যক্তি সংসার ত্যাগ করে বৈরাগ্য জীবন বেছে নিল সে ইসলামের গন্ডির বাইরে চলে গেল। মানব জীবন ও সভ্যতা টিকে আছে বৈবাহিক সম্পর্কে বংশ বিস্তারের উপর। ঐ সম্পর্ক যদি অস্বীকার করা হয়, পাপের কাজ বলে বর্জন করা হয় তাহলে মানব সভতাকেই অস্বীকার করা হবে।

ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম। এর প্রতিটি বিধান মানুষের স্বভাব-সম্মত, জীবন-ঘনিষ্ঠ। এখানেই ইসলামের অনন্ত সৌন্দর্য। ইসলামের মূলকথা সংসার ত্যাগী বৈরাগী নয়, সংসারি সংযমি হতে হবে। তোমার উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা যদি শুদ্ধ সুন্দর হয়, তাহলে বিয়ে-শাদীতেও সওয়াব আছে। এমনকি চরম ও পরম সুখের স্ত্রী সহবাসেও। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি জিন এবং মানবজাতি সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য’। (সুরা যারিয়াত: আযাত-৫৬)

প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা তো সর্বদা নামাজে নিমগ্ন থাকি না, সারা বছর রোজা রাখি না, প্রতি বছর হজ্জে যাই না, সমস্ত সম্পদ দান সদকা করি না, তাহলে আমরা একমাত্র আল¬াহর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি কথাটির স্বার্থকতা কোথায়? মওলানা রূমী একজন পীর ও মুরিদের প্রসঙ্গ এনেছেন মসনবীতে। নতুন মুরিদ নতুন বাড়িতে নিয়ে গেলেন পীরজিকে দাওয়াত দিয়ে। পীর সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়িতে দেয়ালে যে গবাক্ষ, তা কিসের জন্য, আগের দিনে জানালার প্রচলন ছিল না। বাইরের আলো বাতাসের সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য দেয়ালের উপরিভাগে ছিদ্র রাখা হত। ফারসিতে এর নাম রওযান। বাংলায় আমরা গবাক্ষ করলাম।

মুরিদ ভাবল আমার হুজুর একেবারে সহজ সরল মানুষ। গবাক্ষ কেন রাখা হয় তাও বুঝি তিনি বুঝেন না। পীরকে জ্ঞান দিয়ে বলল, কেন হুজুর! বাইরের আলো বাতাস না এলে দম বন্ধ হয়ে যাবে তাই তো রওযান! পীর সাহেব ছোট একটি মন্তব্য করলেন, তাতে মুরিদের দিব্যচক্ষু খুলে গেল। অন্ধকার দুনিয়া যেন আলোকিত হয়ে গেল। বললেন, আলো-বাতাসের চিন্তার সঙ্গে তুমি যদি নিয়ত কর, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান যেন আমি শুনতে পাই, তাহলে এই বাড়ি নির্মাণ, অর্থব্যয়, শ্রমসাধনা নিছক দুনিয়াদারির কাজ আল্লাহর ইবাদতে রূপান্তরিত হবে। বস্তুত অনেক কাজ আছে, যেগুলো করতে গেলে দুনিয়াদারির মতো মনে হয়। কিন্তু শুধু নিয়তের কারণে দ্বীনদারি হয়ে যায়। আবার অনেক দ্বীনদারির কাজ আছে, নিয়ত অশুদ্ধ হওয়ার কারণে, লোক দেখানো কিংবা ধোঁকা দেয়ার মনোবৃত্তির কারণে তা দুনিয়াদারিতে পরিণত হয়। সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বুখারি শরিফের প্রথম হাদিসের ভাষ্য এরূপ- ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়্যাত। নিয়তের উপরই আমলের ফলাফল নির্ভরশীল।

রমজান এসেছে আমাদেরকে ধর্মের সূক্ষ্ম বিষয়াদি শিক্ষা দিতে। আমাদের দিব্যচক্ষু খুলে দিতে। আমরা যেন সবকাজ আল¬াহর ওয়াস্তে করি এবং তা যেন নবীজির পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে আনজাম দেই। সমগ্র জীবন সাধনা যাতে ইবাদতে পরিণত হয়। রমজান শেষে ঈদ এসেছে। ঈদে নতুন জামা চাই। সুন্দর সাজে সাজতে হবে। রমজান একমাস সিয়াম সাধনায় মুমিনদের অন্তর পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর হয়ে যায়। তার প্রতিভাস ফুটে উঠে তার বাহ্যিক অবয়বে পোশাক-পরিচ্ছদে। এ জন্যই ঈদে এতো আয়োজন। আনন্দকে ভাগাভাগি করার তোড়জোড়।

এখানেও যদি আল্লাহর কথা স্মরণ করি। পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটায় সওয়াবের নিয়ত করি, তাহলে সওয়াব আছে। টাকা-পয়সা নিঃস্বার্থভাবে দান করলে সদকায় সওয়াব পাওয়া যায়। কুরআনের বর্ণনায় কমপক্ষে সদকার সওয়াব (১:৭০০) একে সাতশ গুণ। আল্লাহর নবী বলেন, মুমিন বান্দা তার স্ত্রী পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেয়, জামা-কাপড় কিনে দেয় তার মধ্যেও সদকার সওয়াব আছে। মনে রাখতে হবে, শুধু নিজের ও পরিবারের চাহিদা মিটানোর মধ্যে চিন্তা সীমাবদ্ধ রাখা চরম স্বার্থপরতা। কাজটা আল্লাহর ওয়াস্তে হলে অবশ্যই আশপাশের গরীবদের, বিশেষ করে আত্মীয় স্বজনের হিসসা বরাদ্দ থাকতে হবে।

একটি মাসআলা। জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত, যাকে দিচ্ছেন তিনি জাকাত নেয়ার উপযুক্ত কিনা দেখতে হবে। দেয়ার সময় জাকাতের টাকা দিচ্ছি বলা শর্ত নয়। আত্মীয় স্বজন মুরব্বিরা গরীব হলে জাকাত শব্দ উচ্চারণ না করাই উত্তম। ঈদের খরচ বা বকশিস বলে দেয়া যাবে। মনে মনে দেখতে হবে, যাকাত নেয়ার উপযুক্ত কি না। দেখতে গরিব অথচ ব্যাংকে ৫২ তোলা রূপার সমপরিমাণ টাকা এক বছর পর্যন্ত পড়ে আছে, কারো কাছে ঋণগ্রস্তও নয়- এমন গরীব আসলে ধনী। এদেরকে জাকাত দিলে আদায় হবে না। আল্লাহ তাআ’লা আমাদের বুঝার তাওফিক দিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত