ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চীন থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ

* নতুন বাংলাদেশের অংশ হতে চীনা ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ * ঢাকা-বেইজিং এক চুক্তি, ৮ সমঝোতা স্মারক * ৫০ বছর পানি ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান চাইল বাংলাদেশ * রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার চীনের
চীন থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ‘ঐতিহাসিক’ চীন সফরের সময় চীন সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে, যা প্রধান উপদেষ্টা বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসেছে।

চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে আরও প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ প্রদানের পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে।

মিয়ানমার ইস্যুতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিতে এবং দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ইস্যুটির সমাধানকে এগিয়ে নিতে চীনের গঠনমূলক ভূমিকার প্রশংসা করেছে বাংলাদেশ। রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শের মাধ্যমে পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সমর্থনজানিয়েছে চীন। চীন তার সাধ্যমতো প্রত্যাবাসনে সহায়তা অব্যাহত রাখবেও বলে জানিয়েছে। গতকাল চীন-বাংলাদেশের এক যৌথ বিবৃতিতে একথা জানানো হয়। এর আগে সকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে চীন।

গত বছরের আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হয়েছে দেশটি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানানো এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য চীন সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়। উভয় পক্ষই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সুসংবদ্ধ কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে লালন করতে সমান প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বিবৃতিতে জানানো হয়, উভয় পক্ষ একমত হয়েছে, ৫০ বছর আগে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন নির্বিশেষে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক সুস্থ ও স্থিতিশীল উন্নয়ন বজায় রয়েছে। উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি নীতি দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে, তাদের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব এগিয়ে নিতে, রাজনৈতিক পারস্পরিক আস্থা ও উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে সমন্বয় গভীর করতে, চীন-বাংলাদেশ সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতা অংশীদারত্বে এগিয়ে যেতে এবং দুই দেশ ও তাদের জনগণের জন্য বৃহত্তর সুবিধা আনতে সম্মত হয়েছে।

এতে বলা হয়, চীন সবসময়ই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সুপ্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে আসছে এবং কার্যকরভাবে সুশাসন চর্চা, বাংলাদেশে ঐক্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ ‘এক চীন’ নীতির প্রতি তার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বৈধ সরকার এবং তাইওয়ান চীনের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ উল্লেখ করে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’র বিরোধিতা করে বাংলাদেশ।

চীনের মূল স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় দেশটির প্রচেষ্টার বিষয়ে বাংলাদেশ সমর্থন করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিল্পায়নের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের প্রতি চীন সমর্থন অব্যাহত রাখবে। বাণিজ্যিক নীতি ও বাজারভিত্তিক পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে বস্ত্র ও পোশাক, ক্লিন এনার্জি, ডিজিটাল অর্থনীতি, কৃষি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সহযোগিতা পরিচালনায় চীনা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে দেশটি। মোংলাবন্দর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোকে অংশগ্রহণের জন্য স্বাগত জানায় বাংলাদেশ।

চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্প অঞ্চল (সিইআইজেড) আরও উন্নয়নে চীনা পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে। উভয় পক্ষ যত দ্রুত সম্ভব চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু এবং চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ চুক্তি অনুকূল করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করে। যত দ্রুত সম্ভব চীনে বাংলাদেশের আম এবং অন্যান্য কৃষি ও জলজ পণ্যসহ উচ্চমানের পণ্য রফতানির বিষয়টি উপলব্ধি করতে সম্মত হয়েছে উভয় পক্ষ। চীনের সঙ্গে সহযোগিতা সম্প্রসারণে চীনের ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপো, চায়না-সাউথ এশিয়া এক্সপো এবং চায়না ইন্টারন্যাশনাল সাপ্লাই চেন এক্সপোর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর পূর্ণ ব্যবহার করায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য অনুকূল বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ তার প্রস্তুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।

উভয় পক্ষ জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত পূর্বাভাস, বন্যা প্রতিরোধ ও দুর্যোগ হ্রাস, নদী খনন, জলসম্পদের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, জলসম্পদ উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। ইয়ারলুং জানবো-যমুনা নদীর জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছে উভয় পক্ষ। তিস্তা নদীর কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্টে (টিআরসিএমআরপি) চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়েছে।

উভয় পক্ষ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং ব্লু ইকোনমির সহযোগিতার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে সম্মত। সামুদ্রিক বিষয়ে বিনিময় জোরদার করতে এবং উপযুক্ত সময়ে সামুদ্রিক সহযোগিতার বিষয়ে নতুন দফার সংলাপ আয়োজনে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ-চীন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাকে এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও চীনা জনগণের আন্তরিক প্রশংসা করেন এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের জন্য প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানান।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মাত্র ৮ মাস আগেই বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। ভয়ংকর সব বিষয় থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। তরুণদের কারণে পরিপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তরুণরা নতুন বাংলাদেশ তৈরির কথা বলছে। শুধু ব্যবসার জন্য না, পরিবর্তনের অংশ হতে আপনাদের এই নতুন বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। গতকাল বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত চীনের ব্যবসায়িক নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এই আমন্ত্রণ জানান।

বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠী পূর্ণ উদ্যম ও সৃজনশীলতায় ভরপুর মন্তব্য করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং প্রতিদিন তা আরও বাড়ছে। ১৭ কোটি মানুষের বসবাস এখানে। এই জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষের বয়স ২৭ বছরের নিচে। তারা সব ধরনের অপ্রত্যাশিত কাজ করতে প্রস্তুত, যা কেউ কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। বাংলাদেশের এটি একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে আমরা যখন স্বাধীন হয়েছি, তখন থেকে আমরা কৃষি প্রধান জাতি। অত্যন্ত অল্প পরিসরে পোশাক উৎপাদন থেকে শুরু হয় আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প। কারণ হংকংয়ের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছিল। আজকে চীনের পর বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী দেশ।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দাঁড়িয়েছে নারীদের অংশগ্রহণে। তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিক নারী। বাংলাদেশের চারপাশ নেপাল, ভুটান পরিবেষ্টিত। আমার বলার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ খুব চমৎকার একটি লোকেশনে অবস্থিত। বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর আছে, যা কি না বিশ্বের সঙ্গে একটা বড় সংযোগ স্থাপন করেছে।

নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে খুব দ্রুত আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নেপাল, ভুটানকে যদি অবস্থান করতে হয়, তাহলে তাদের বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাদের পণ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাঠাতে হয় এবং আনতে হয়। তারপর ভারতের দিকে তাকান, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য, যাকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়, তারাও ভূমিবেষ্টিত, কোনও সমুদ্র নেই। সেভেন সিস্টার্স, নেপাল, ভুটানকে ব্যবসা করতে হলে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই করতে হয়। সুতরাং শুধু বাংলাদেশের নিজের জন্য না অন্যদের জন্য এটি হচ্ছে একটি পথ।

ড. ইউনূস বলেন, আপনারা এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন, এ অঞ্চলে ব্যবসা করে। ব্যবসায়ীরা আসুক, তাদের কারখানা স্থাপন করুক, পুরো অঞ্চলে এমনকি বিশ্বে সরবরাহ করুন। যাতে আমরা এখানে একটি প্রডাকশন হাব করতে পারি। এখানে তরুণ কর্মীর কিন্তু অভাব নেই। তারা নতুন বিশ্বের সঙ্গে বেশ পরিচিত এবং খুব দ্রুত তারা শিখতে পারে। যদি আপনারা সংযোজন কারখানা করেন, প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা স্থাপন করেন, আমি মনে করি বাংলাদেশকে এই ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশ ও চীন অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা–সংক্রান্ত একটি চুক্তি এবং ক্ল্যাসিক সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবদুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উপ-প্রেস সচিব আরও জানান, বিনিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা, চীন শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল শুরুর ঘোষণা, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং হৃদ্?রোগ সার্জারি যানবাহন দানের বিষয়ে পাঁচটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত