‘আপনি যে এই বাড়ির, জায়গা-জমির মালিক, প্রমাণ কী? এই সম্পদ আমার। আমার জমিজমার দলিল আছে, খতিয়ান আছে। সব কাগজপত্র আছে। কাজেই আমার মালিকানা সত্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না’। মুসলমান হিসেবে আপনার দাবি, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। ইসলাম আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম। মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই দাবির পক্ষে সাক্ষী-প্রমাণ কী আছে? এর সরল ও সঠিক উত্তর হচ্ছে- ‘আমাদের কাছে কোরআন আছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে প্রেরিত মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এখনো আমাদের মাঝে বিদ্যামান। সত্যিই মুসলিম উম্মাহ বড় সৌভাগ্যবান। তাদের কাছে আছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। পৃথিবীতে আরো বহু ধর্ম আছে। তাদের কাছেও ধর্মগ্রন্থ আছে। ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা দাবি করে বাইবেল ঈশ্বরের বাণী। আমরাও স্বীকার করি, আমাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে, ইহুদি খ্রিস্টান তথা বনি ইসরাঈল বংশের সব নবীগণের কাছে আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়েছিল। দাউদ (আ.)-এর কাছে প্রেরিত আসমানী কিতাবের নাম যবুর। মুসা (আ.) এর কাছে প্রেরিত গ্রন্থ হচ্ছে তওরাত। ঈসা (আ.)-এর কাছে প্রেরিত আসমানী কিতাবের নাম ইনজিল। কিন্তু কিতাবগুলো তারা হুবহু সংরক্ষণ করেনি। নিজেদের স্বার্থে বিভিন্নভাবের বিকৃত করেছে।
আল্লাহর দেয়া হুকুম আহকাম ওলট-পালট করেছে। ফলে, আসমানী কিতাবের মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এমন হয়েছে যে, এসব গ্রন্থের কোনটি আল্লাহর বাণী, কোনটি নবীর বাণী, কিংবা কোনটি কিতাব সংকলকের অভিমত ফারাক করা যায় না। গ্রন্থগুলো তার আদিরূপেও বর্তমান নেই। সবগুলো নতুন রূপ নিয়ে নামধারণ করেছে বাইবেল। বাইবেলের নতুন নিয়ম ও পুরাতন নিয়ম নামে আগের ও পরের কিতাবগুলোর মাঝে পার্থক্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, খ্রিস্টান বা ইহুদি সমাজের লোকেরা ঈশ্বরের খাঁটি বাণী কোনটি জানতে ও মানতে চাইলে বাইবেলের সূত্রে তা পারবে না।
হিন্দু ধর্মের বেদ ও বৌদ্ধ সমাজের ত্রিপিটক কোনোভাবেই ঐশী বাণী নয়। এ সব গ্রন্থ ঈশ্বরের পক্ষ হতে তাদের মুণি-ঋষির উপর অবতীর্ণ হয়েছে বলে নিজেরাও দাবি করে না। বড়জোর এগুলো মুনি-ঋষির বাণী হতে পারে। তাও কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত ও বিকৃত। পৃথিবীর বুকে কোরআনই একমাত্র আসমানী ধর্মগ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী সকল ধর্মগ্রন্থের নির্যাস এবং মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের শান্তি ও মুক্তির সব নির্দেশনা রয়েছে। দেড় হাজার বছর আগে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর উপর যখন এই কোরআন নাজিল হয়, তখন কোরআন মুহাম্মদ (সা.) এর নিজের রচনা বলে কাফেররা অভিযোগ তুলেছিল। কোরআন তখন ঘোষণা করেছিল, কোরআন আল্লাহর বাণী এই ব্যাপারে যদি তোমাদের সামান্যতম সন্দেহ হয়, যদি বলতে চাও যে, এই গ্রন্থ কোনো মানুষের রচিত, তাহলে এর দশটি সুরার মতো কথামালা কিংবা পরিশেষে এর একটি ছোট সুরার তুল্য বাক্যাবলি রচনা কর।
তখনকার পৃথিবীতে আরবরাই ছিল ভাষা সাহিত্যে বিশ্বসেরা। এখনো আরবি ভাষার ঐশ্বর্য অতুলনীয়। মুসলমান ছাড়াও বহু ইহুদি খ্রিস্টান পণ্ডিত আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিরাট পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কোরআনের ছোট সুরার সমতুল্য কোনো সুরা রচনার সেই চ্যালেঞ্জ এখনও বলবৎ আছে। কিন্তু দুনিয়ায় তাবৎ ভাষাবিজ্ঞানীরা এই চ্যালেঞ্জ অতীতে গ্রহণ করেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এই মহাগ্রন্থ যুগ-যুগান্তরের সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে স্বমহিমায় ভাস্বর।
রমজান মাসে কোরআনুল করিম নাজিল হয়েছে শবেকদরের রাতে। সে উপলক্ষে পুরো রমজানে কুরআনের অনুশীলন হয় অভিনব পন্থায়। তারাবি নামাজে, ব্যক্তিগত তেলাওয়াতে। কোরআন নাজিল হয়েছে মানবজাতির, বিশেষ করে মুসলমানদের পথের দিশা হিসেবে। তার জন্য শুধু তেলাওয়াত ও কোরআনের হেফাজত করা যথেষ্ট নয়। কোরআন বুঝতে হবে, চর্চা করতে হবে। যে কারণেই হোক কোরআন নাজিলের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ কোরআন থেকে হেদায়াত লাভের সেই চিন্তা থেকে মুসলিম সমাজ দূরে সরে গেছে। শুধু তিলাওয়াতকেই যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে। আল্লামা ইকবাল এর পরিণতি চিন্তা করে অতীত বর্তমানের মূল্যায়ন করেছেন। বলেছেন-
উয়ে-জামানা মে মুয়াজ্জাজ থে মুসলমান হো কর
অউর তোম খার হুয়ে তারেকে কোরআন হো কর।
আগেকার মুসলমানরা দুনিয়ার বুকে সম্মানিত ছিল খাঁটি মুসলমান হওয়ার কারণে। আর তোমরা অপমানিত হয়েছ কোরআন ছেড়ে দেয়ার কারণে। আমরা কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী পথ চলছি না। আমাদের শাসকরা কোরআনের বিধান ও শিক্ষার তোয়াক্কা করে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোরআনের নির্দেশনা মানেন না, শত্র মিত্র নির্ণয়ে কোরআন মানদ- বলে স্বীকার করে না। ইহুদি খ্রিস্টানদের বন্ধু ভেবে জাতীয় সম্পদ তাদের জন্য উজাড় করে দিয়েছে। অথচ দেখতে পাচ্ছে যে, শত্রু নির্দয়ভাবে ফিলিস্তিনের গাজায় মুসলমানদের উপর নিষ্ঠুর পন্থায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিবাদ করার মোরদটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে, শিক্ষিত হয়, কিন্তু শিক্ষার মূল সিলেবাস হিসেবে আল্লাহ পাক যে কোরআন নাজিল করেছেন, তার বাস্তবায়ন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। আমাদের জাগতে হলে অবশ্যই কোরআন বুকে ধারণ করতে হবে। এই বুকে ধারণ করার মানে, আমাদের শিক্ষার সর্বস্তরে কোরআন সিলেবাসভুক্ত হওয়া চাই। কোরআনের আইন ও বিধান সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের উদ্যোগ চাই। তবেই রমজানে কোরআনের অনুশীলন সার্থক হবে। আমাদের জীবনের জন্য সুফল বয়ে আনবে।