ঢাকা বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আনন্দ ও বিষাদময় ঈদের শুভেচ্ছা

আনন্দ ও বিষাদময় ঈদের শুভেচ্ছা

এবারের ঈদ এসেছে আনন্দ ও বিষাদের বার্তা নিয়ে। গেল জুলাই-আগস্টে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর একটি শাসক দল দেশ ও জাতির ভাগ্যবিধাতা হয়ে বসেছিল। বিরোধীমতের লোকদের ওপর দমন-পীড়ন, গুম, হত্যা, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোসহ কোনো অপকর্ম বাদ রাখেনি। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করার দাবিতে ছাত্ররা মাঠে নামল। জুলাই মাসব্যাপী সরকার চরমপন্থায় ছাত্রদের দমনের পথ বেছে নিল। ছাত্ররা সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে চাইল। প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন থেকে শেখ হাসিনা কোনো পাত্তা দিল না। শেষ হাসিনার পতনের ডাকে ঐক্যবদ্ধ হলো। তিনি ৫ আগস্ট দুপুরে ‘ভারা ভাত পাতে রেখে’ পালিয়ে গেলেন পাশের দেশ ভারতে। তার পতনের পর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র ভেসে আসতে লাগল। বাংলা অভিধানে যুক্ত হল আরেকটি পরিভাষা আয়নাঘর। যে ঘরে আবদ্ধ রেখে বিরোধী মতের লোকদের উপর চালানো হতো অবর্ণনীয় নির্যাতন। গুম করা হত। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে লাখ লাখ টাকা বিদেশে পাচার ও লুটপাতের ফিরিস্তি প্রকাশ হল। এই পটপরিবর্তনের পরে ক্ষমতায় এসেছেন অন্তর্বতীকালীন সরকার। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নন্দিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রধান, প্রধান উপদেষ্টা। গেল দুই যুগের পর এবারই প্রথম ইফতার, তারাবী, সাহরিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বলবৎ ছিল। শাক-সবজির মূল্য সহনীয় পর্যায়ে ছিল। ডলারের মোকাবিলায় টাকার দরপতনের মতো বিপর্যয় ঘটেনি। যদিও বড় বড় কোম্পানিগুলো জিনিসের দাম কমায়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে বিপর্যয় হয়েছে। সিন্ডিকেটগুলো খোলস পাল্টেছে বহাল তবিয়তে। তবুও ব্যাংকিং সেক্টরে অস্থিরতায় স্বস্তির বাতাস লেগেছে বলে মনে হয়। সবচে বড় কথা মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারছে। এতটুকু স্বাধীনতাকে মানুষ নতুন বাংলাদেশ ও নতুন স্বাধীনতা হিসেবে উৎযাপন করছে।

পরের গল্প ভয়ের। ভারতের মদদে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পায়তারা কথা শোনা যাচ্ছে। সেনাবাহিনী যেকোনো দেশের গর্বের ও অস্তিত্বের পাহাদার। সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টির গভীর তৎপরতার কথা জনসম্মুখে আসাতে আমরা আতঙ্কিত।

আমরা ছোট দেশ; কিন্তু বড় বড় শক্তি আমাদের প্রতি লোভাতুর। ভারত আমাদের করদরাজ্য বানিয়ে রেখেছিল; কিন্তু পারেনি। চীন ও আমেরিকা দুইটি রশি নিয়ে দুই দিকে টানছে। এই ত্রিশংকুল টানে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ধরে রাখতে হবে। প্রমাণ করতে হবে আমরা অজেয়। তাদের দৃষ্টি কিন্তু বঙ্গোপসাগর, আরো সাফ কথায় গভীর সমুদ্রবন্দর।

আমাদের রাজনীতিবিদদের সামনে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় না। তারা চিন্তায় নির্বাচন কবে হবে। ভারতও চায় তাড়াতাড়ি নির্বাচন। যেভাবেই হোক শেখ হাসিনার পুর্নবাসন। সংস্কার একটি দুর্বোধ্য পরিভাষা, এতো জুলম, লুটপাট হলো; কিন্তু বিচারের কথা নাই। সংস্কার দিয়ে কী হবে, কী জন্য তা বোধগম্য নয়।

বিপুল জনসংখ্যার ছোট দেশে স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে হলে নিজস্ব ভিত্তি থাকতে হবে। এই ভিত্তি আদর্শের, জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধের। স্বাতন্ত্র্যবোধ মানে, আমরা আলাদা, অন্যদের থেকে পৃথক। গায়ের বর্ণ ও মুখের ভাষায় তো ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য আমাদের নেই। তাহলে, কীভাবে স্বতন্ত্র হবে? হ্যাঁ ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের বিচারে আমরা আলাদা। এই পরিচয়ের ভিত্তিতে আমরা স্বতন্ত্র জাতিসত্তায় উজ্জীবিত।

পবিত্র মাহে রমজানে বাংলাদেশের জনজীবনের যে চিত্র, ঈদুল ফিতরের মাঠে ঘরে বাইরে যে সংস্কৃতির প্রদর্শনী হয়, সেটিই আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার সারণী। আমরা আল্লাহতে বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাসের উপর দন্ডায়মান আমাদের কালচার, আমাদের মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ধর্মীয় মাহফিল, তারাবিহ, ইফতার, জাতীয় উৎসব, ঈদের আয়োজন। ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও এখানে তাদের ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ধার্মিক। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই স্বতন্ত্র জাতিসত্তার নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।

সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন এনে তিনি সংযোজন করেছিলেন বিসমিল¬াহির রহমানির রহিম ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণআস্থা ও বিশ্বাসের মূলনীতি। জেনারেল এরশাদও স্বতন্ত্র জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন ইসলামি মূল্যবোধে, সংবিধানের রাষ্ট্রর্ধম ইসলাম তার সেই উপলব্ধির পরিচয়বাহক। বর্তমান রাজনীতিকদের মনে হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের নিয়ামক স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রতি তারা উদাসীন।

আমরা বিশ্বজনীন মুসলিম উম্মাহর অংশ এক দেহের অঙ্গের মতো। হাদিসের ভাষ্য, দেহের এক অঙ্গ যদি ব্যথায় কাতর হয়, সকল অঙ্গ জ্বরে ও বিনিদ্রায় সমব্যথী হয়। আজ মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ফিলিস্তিনে, গাজায় আমার ভাই-বোনেরা, শিশুরা ইয়াহুদিবাদী ইসরাঈলের ধ্বংসাযজ্ঞে পিষ্ট হচ্ছে। এতোগুলা আরব দেশ, এতো সংখ্যক মুসলিম দেশ অসহায় গাজাবাসীর জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আরব বিশ্ব নির্বিকার থাকায়, বড়দেশটির তরুণ শাসকের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েল মানব ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা চালিয়ে যেতে পারছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ঈদ পালন করতে হচ্ছে, এর চেয়ে বিষাদময় ঈদ আর কী হতে পারে।

এত দুঃখ বিষাদের মাঝেও ঈদ এসেছে। ফিলিস্তিনেও ঈদ এসেছে। গাজায়ও ঈদ আসবে, ইনশাআল্লাহ। ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। মিথ্যার পরাজয় হবে। গাজাবাসী প্রাণ উজাড় করে ঈদের আনন্দে মেতে উঠবে। সমগ্র বিশ্বে ঈদের আনন্দবার্তা উপহার দিবে। সত্যের জয় হবে নিশ্চয়ই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত