ঢাকা সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মার্কিন শুল্কে ভারতের চেয়ে কম আক্রান্ত হবে বাংলাদেশ

মার্কিন শুল্কে ভারতের চেয়ে কম আক্রান্ত হবে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৮০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন, যাকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে অনেক দেশ। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক ছিল।

বাংলাদেশের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের একটি বড় অংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলারে। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকাল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে উপস্থিত সাংবাদিকসহ সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্যের শুরুতেই ট্রাম্প বলেন, ‘আজ খুব ভালো খবর’ থাকবে। এসময় দর্শক সারি থেকে করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়।

এই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস’ অভিহিত করেন ট্রাম্প। নতুন শুল্ক আরোপকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, এই দিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে।

কোন দেশে কত শুল্ক : ট্রাম্পের পাল্টা এই শুল্ক আরোপে ভারতের পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৪ শতাংশ।

এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার পণ্যে ৪৪ শতাংশ, তাইওয়ানের পণ্যে ৩২ শতাংশ, জাপানের পণ্যে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের পণ্যে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের পণ্যে ৩১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ার পণ্যে ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের পণ্যে ১০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের পণ্যে ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের পণ্যে ১০ শতাংশ, ইসরায়েলের পণ্যে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনের পণ্যে ১৭ শতাংশ, চিলির পণ্যে ১০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্কের পণ্যে ১০ শতাংশ, কলম্বিয়ার পণ্যে ১০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে।

অন্যান্য যেসব দেশের পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের পণ্যে ৪৪ শতাংশ, লাওসের পণ্যে ৪৮ শতাংশ এবং মাদাগাস্কারের পণ্যের ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

ট্রাম্প বললেন, আমেরিকান শিল্পের পুনর্জন্ম : পাল্টা এই শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে থাকা ট্রাম্প বলেছেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ‘বন্ধু শত্রুর চেয়ে খারাপ হয়’।

যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের বিদেশি গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব গাড়ি উৎপাদন করা হয় তার ৮০ শতাংশের বেশি সে দেশে বিক্রি হয়। আর জাপানে যেসব গাড়ি বিক্রি হয় সেগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি সে দেশে তৈরি হয়। এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি বিক্রি হয় খুব সামান্য।

মার্কিন কোম্পানি ফোর্ড অন্যান্য দেশে খুব কম গাড়ি বিক্রি করে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, অন্য যে কোনো দেশে তৈরি মোটরযানের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে।

শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, আজকের দিনকে আমেরিকান শিল্পের ‘পুনর্জন্ম’ এবং আমেরিকাকে ‘আবার সম্পদশালী’ করার দিন হিসেবে স্মরণ করা হবে।

এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বাধার মুখে রয়েছে।

অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা আরও খারাপ অবস্থা তৈরি করেছে।

বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মেধাসত্ত চুরিসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ আরোপের অভিযোগ করেন তিনি।

কেউ থাকে না, এমন দ্বীপেও ১০ শতাংশ শুল্ক : কেউ ভাবতে পারেনি যে ট্রাম্পের শুল্কের আওতা থেকে জনমানবহীন দ্বীপগুলোও রেহাই পাবে না!

সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের তালিকায় ছিল অস্ট্রেলিয়ার অধীনে থাকা হার্ড ও ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপ। এই দ্বীপগুলো ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এবং সেখানে কোনো মানুষ বসবাস করে না।

হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা অবশ্য জানাচ্ছেন, দ্বীপগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, কারণ সেগুলো অস্ট্রেলিয়ার অংশ। ট্রাম্প তার বক্তব্যে একটি পোস্টার দেখান, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও অঞ্চলগুলোর নাম ছিল। সাংবাদিকদের জন্য ছাপানো কাগজেও বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়।

সেই তালিকায় হার্ড ও ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য বাধা’ রয়েছে দ্বীপগুলোতে। এর প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার সরকারি ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, হার্ড ও ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম এবং বন্য এলাকা। অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টার্কটিক প্রোগ্রামের তথ্যমতে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরের কাছে ফ্রিম্যান্টল বন্দর থেকে জাহাজে করে দ্বীপে পৌঁছাতে প্রায় ১০ দিন সময় লাগে, তাও আবার আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে।

এই দ্বীপগুলো বিভিন্ন সংরক্ষিত পেঙ্গুইন, সীল এবং উড়ন্ত পাখির আবাসস্থল। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় থাকা এই অঞ্চল প্রায় ১০ বছর ধরে কোনো মানুষের পদচিহ্ন দেখেনি বলে দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে।

হার্ড ও ম্যাকডোনাল্ড দ্বীপ ছাড়াও ট্রাম্পের শুল্কের তালিকায় ছিল অস্ট্রেলিয়ার কোকোস (কিলিং) দ্বীপ, ক্রিসমাস দ্বীপ এবং নরফোক দ্বীপ।

নরফোক দ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ২১৮৮ জন, তবে পুরো অস্ট্রেলিয়ার জন্য নির্ধারিত ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেখানে।

শুল্ক কবে থেকে কার্যকর : ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক দুটি ধাপে কার্যকর হবে। প্রথম ধাপে, ন্যূনতম শুল্ক ( ১০ শতাংশ) আগামী ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। দ্বিতীয় ধাপে, উচ্চতর শুল্ক (যেমন বাংলাদেশের জন্য ৩৭ শতাংশ) ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।

বাংলাদেশের ওপর প্রভাব : বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে, বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের ওপর ঠিক কী হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বিষয়টি হলো- শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। পাকিস্তান ও চীনের ওপর আরোপ করা শুল্কও বাংলাদেশের কাছাকাছি। সে কারণে হয়তো তৈরি পোশাকশিল্প অতটা আক্রান্ত হবে না, এমন ধারণা কেউ কেউ করছেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগীদের মধ্যে তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ৩০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ ও কম্বোডিয়ার ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর শুল্ক আমাদের চেয়ে কম। এই ফাঁকে ভারত হয়তো লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তারা এমনিতেই কিনবে কম; এর জেরে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তবে শুল্কের হিসাবে ফাঁকি আছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে বানানো বড় কোনো ব্র্যান্ডের শার্ট যুক্তরাষ্ট্রের দোকানে এতদিন ২০ ডলারে বিক্রি হতো। সেই ব্র্যান্ড হয়তো বাংলাদেশের গার্মেন্ট কোম্পানি থেকে সেই শার্ট কিনছে পাঁচ ডলার ইউনিট প্রাইসে। শুল্কের হিসাবের ফাঁকটা হলো- এটি আরোপ করা হয় বন্দরে আমদানির সময়ের ক্রয়মূল্যের ওপর, বাজার মূল্যের ওপর নয়। এখন হিসেব করলে দেখা যাবে, সেই পাঁচ ডলারের শার্টের ওপর আগে শুল্ক আসত ৭৫ সেন্ট, এখন আসবে ২ ডলার ৬০ সেন্ট। আগের চেয়ে বেশি দিতে হবে ১ ডলার ৮৫ সেন্ট। ফলে ২০ ডলারের ওই শার্টের দাম প্রায় দুই ডলার বাড়িয়ে সেই ব্র্যান্ড অনেকটাই সামাল দিতে পারবে। আরেকটি সুবিধা হলো, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, চীন বা এমনকি ভারত এখন উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে তারা যতটা আক্রান্ত হবে, বাংলাদেশ ততটা হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

তারপরও অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের উচিত মার্কিন পণ্যের শুল্ক কমানো, সেটা হলে আমাদের পণ্যে মার্কিন শুল্ক কমে যাবে।

বাংলাদেশের উচিত, মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচলিত শুল্কের হার ৭৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা। এর ফলে বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্ক হবে ১৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে রপ্তানি যোগ-বিয়োগ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়ায় আমরা লাভবান হব।

সানেমের নির্বাহী পরিচালকের বিশ্লেষণ : সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই পরিবর্তন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এমন একটি অনিশ্চিত ব্যবস্থায় কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

বিশাল শুল্কের কারণে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম প্রধান রপ্তানি গন্তব্য। শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বৈশ্বিক রপ্তানির ১৭ থেকে ১৮ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে।

ইউএসটিআরের (ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ১.১ শতাংশ বেড়ে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অবদান তৈরি পোশাক খাতের। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি ১.৫ শতাংশ কমে ২.২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এর ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৬.২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক রায়হান লিখেছেন, ‘এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে কারা লাভবান হবে আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নির্ধারণ করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে এটি বিশ্ব বাণিজ্য পরিবেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে।

ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতি নিয়ে এইচঅ্যান্ডএমসহ প্রধান পোশাক খুচরা বিক্রেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এইচঅ্যান্ডএমের সিইও ড্যানিয়েল এরভার বলেছেন, এই শুল্কের কারণে মার্কিন ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যাপারে কৌশলী হতে হবে। অধ্যাপক রায়হান লিখেছেন, ‘এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অবশ্যই তার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে এবং পরিবর্তিত বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করতে মূল অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’

পোশাক রপ্তানিকারকরা কী বলছেন : দেশের দুই পোশাক রপ্তানিকারকের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক তুলে নেয়া অথবা তা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে নির্মাণসামগ্রী, কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করে। গতকাল বৃহস্পতিবার শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক কমানো সম্ভব হবে।’

বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশটি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রেক্ষাপটে তিনি এ মন্তব্য করেন। তার মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক কাঠামোর ফলে ভারত ও পাকিস্তান থেকে পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের তুলনায় সস্তা হতে পারে। কারণ সেসব দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগীদের তুলনায় উচ্চ রপ্তানি শুল্ক ও চীন থেকে শিল্প স্থানান্তর নিয়ে অনিশ্চয়তা বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। রাজস্বের জন্য আমদানি করের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা এখন শুল্ক শিথিল করার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের পোশাক খাতের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা চাপে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশই আক্রান্ত হচ্ছে না। প্রায় ৬০ দেশে এর প্রভাব পড়বে।’

‘নিঃসন্দেহে, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে।

তালিকায় রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার নাম নেই কেন : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন। নতুন করে পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার তিনি বেশ কয়েকটি দেশের ওপর সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কয়েকটি দেশের নামও আছে ওই তালিকায়। কিন্তু ট্রাম্পের সর্বশেষ শুল্ক আরোপের তালিকায় নেই রাশিয়া, কানাডা, মেক্সিকো, উত্তর কোরিয়া, কিউবাসহ আরও কয়েকটি দেশের নাম। কী কারণে ট্রাম্প এসব দেশকে বাদ দিলেন?

ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় গত বুধবার বিকাল ৪টায় হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার ট্রাম্প যাদের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন, এর মধ্যে ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভিয়েতনামের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্যিক অংশীদাররাও রয়েছে। ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ২০ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে কেন নেই রাশিয়া, কানাডা, মেক্সিকো, উত্তর কোরিয়া কিংবা কিউবার নাম? দেশগুলো কি আসলেই ট্রাম্পের শুল্ক খাঁড়া থেকে বাঁচতে পেরেছে?

প্রতিবেশী দুই দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর আগেই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কানাডার জ্বালানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির (ইউএসএমসিএ) আওতায় যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে, সেগুলো এখনও নতুন শুল্কের আওতামুক্ত রয়েছে। তবে গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য পণ্যের ওপর বৃহস্পতিবার থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হবে।

ট্রাম্পের সর্বশেষ শুল্ক আরোপের তালিকায় কেন রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও বেলারুশের নাম নেই, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোয়াইট হাউসের ওই কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এসব দেশের ওপর আগে থেকেই বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য খুবই সামান্য।

ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব দেশ আগে থেকেই অতি উচ্চ শুল্কের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া দেশগুলোর ওপর আমরা আগেই যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছি, তাতে তাদের সঙ্গে কোনো অর্থপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। ভারতভিত্তিক বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম জিরাফের সহপ্রতিষ্ঠাতা সৌরভ ঘোষ রাশিয়ার ওপর শুল্ক আরোপ না করার আরেকটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। সেটা হলো ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে চলমান আলোচনা।

সৌরভ ঘোষ বলেন, রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য এমনিতেই তলানিতে। তার ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চান, তবে তাকে রাশিয়ার প্রতি সমর্থনমূলক আচরণ করতে হবে। যেসব দেশ রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনছে, সেসব দেশের ওপর ট্রাম্প নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব দেশের উচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তারাই মূলত এবার ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৯ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

সৌরভ ঘোষ ব্যাখ্যা দিয়ে আরও বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, তাই স্বাভাবিকভাবে তালিকায় তাদের নামই বেশি। সৌরভ বলছেন, তার ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর এবং অন্যায্য মুদ্রা হারসহ অ-শুল্ক বাধাগুলো পারস্পরিক শুল্ক নির্ধারণে ভূমিকা পালন করেছে। মনে হচ্ছে, অন্যান্য অন্তর্নিহিত মানদণ্ডকে বিবেচনায় না এনে বাণিজ্যে ভারসাম্য আনাই শুল্ক আরোপে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। সৌরভের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের তালিকায় যেসব দেশের নাম সবচেয়ে অবাক করা তার অন্যতম দুটি হলো, জাপান (২৪ শতাংশ) ও ভিয়েতনাম (৪৬ শতাংশ)। ট্রাম্পের এই শুল্ক এরই মধ্যে বিশ্ববাণিজ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। কানাডা ও মেক্সিকো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো শুল্কের প্রভাব মোকাবিলা ও তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে। আর রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া আপাতত ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তুর বাইরে রয়েছে। তবে আগামী কয়েক মাসে কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন থাকে তার ভিত্তিতে সবকিছু বদলে যেতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত